মোঃ সোহেল রানা রাজশাহী বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান
রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রামেবি) জন্য অধিগ্রহণ করা ২০৫ বিঘার বিশাল ক্যাম্পাস এলাকা থেকে শত শত গাছ লুট হয়ে গেছে। সেগুলো কেটে বিক্রি হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব থেকেছে। গত কয়েক মাস ধরে ধাপে ধাপে এবং গত এক মাসে ব্যাপকভাবে এসব গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে পুরো এলাকায় রয়েছে সাত হাজার ৩০০ গাছ। যার মধ্যে ক্যাম্পাসের উন্নয়ন কাজ করার জন্য প্রায় সাড়ে ৫ হাজার গাছ কেটে ফেলার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো বিক্রির জন্য নাম্বারিং করা হলেও এখনো কোনো দরপত্র হয়নি; গাছ কাটার জন্য কাউকে কার্যাদেশও দেওয়া হয়নি। অথচ অসংখ্য গাছ গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়েছে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গাছের কাটা গোড়া মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে, কিছু গাছের গোড়া তুলে ফেলায় সেখানে গর্ত হয়ে পানি জমে আছে এবং কোথাও কোথাও জায়গা ফাঁকা করে শাকসবজি চাষও হচ্ছে।
রাজশাহীর সিলিন্দা এলাকায় এই ভূমি একসময় ছিল আমবাগান, মেহগনি বাগান আর নানা ফলজ-বনজ গাছে ভরা। এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে পড়ে থাকা শুকনো ডালপালা, গোড়া থেকে কেটে নেওয়া আমগাছের কাণ্ড কিংবা কেটে ফেলে রাখা অর্ধশতাধিক গাছ। জমির ভেতর তৈরি হয়েছে ছোট ছোট গর্ত, যেখানে বৃষ্টির পানি জমে আছে। ক্যাম্পাসের পূর্ব পাশ দিয়ে সীমানাপ্রাচীর নির্মাণে শত শত গাছ আগে থেকেই কেটে ফেলা হয়েছিল।
স্থানীয়রা জানান, গত এক মাস ধরে ট্রলির পর ট্রলি গাছ এখান থেকে বাইরে নেওয়া হয়েছে। ববিতা বেগম নামের এক নারী বলেন, মাঝে মাঝেই গাছ কাটা হতো, তবে গত এক মাস ধরে প্রতিদিনই গাছ কেটে বাইরে নেওয়া হয়েছে।
শারমিন বেগম নামের আরেক নারী জানান, গত মঙ্গলবার সকালেও দুই ট্রলি গাছ কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এর আগের দুই দিনেও আরও চার ট্রলি গাছ কাটা হয়েছে। তাদের ভাষায়, একসময় যেখানে বাগান ছিল, এখন তা ফাঁকা মাঠে পরিণত হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা ও বালুভরাট কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হোসাইন কন্সট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড যোগসাজশে এসব গাছ কেটে বিক্রি করেছে।
সূত্রের দাবি, রাজনৈতিক প্রভাবশালী এক সাবেক ছাত্রনেতা নামমাত্র মূল্যে বাগান ইজারা নিয়ে আম ও কাঠ বিক্রির ব্যবসা করেছেন। গত মৌসূমে কেবল আম বিক্রিই হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকার। গাছ কাটার সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা ও উপাচার্যের ঘনিষ্ঠজনদের নামও উঠে এসেছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
রামেবি স্থাপন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী সিরাজুম মুনীর বলেন, গাছ কাটার অনুমতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। অনিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রায় ৭০০ গাছ কাটা হয়েছে, তাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করা হয়েছে। তাদের জবাব পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রামেবির রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. হাসিবুল হোসেন বলেন, গাছ কাটার বিষয়ে তিনি অফিসিয়ালি কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত নন, তাই বিষয়টি সম্পর্কে অবগতও নন। উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী নাজমুল হোসেন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই।
অন্যদিকে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হোসাইন কন্সট্রাকশনের রাজশাহীর ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন দাবি করেন, তাদের কাজ কেবল বালুভরাট করা। যেদিকে গাছ কাটা হয়েছে, সেদিকে তাদের কোনো কাজই নেই। তাই তারা দায়ী নন।
এদিকে, স্থানীয় অনেকের মতে, দীর্ঘদিন ধরে গাছ কাটার প্রক্রিয়া চললেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব থেকেছে। গত এক মাসে ব্যাপকভাবে গাছ কাটা শুরু হলে বিষয়টি বিভিন্ন মহলে জানাজানি হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শোকজ নোটিশ দিতে বাধ্য হয়। এখন প্রশ্ন উঠছে, দরপত্র ছাড়াই কীভাবে এত গাছ কেটে বিক্রি হলো, কারা এ লুটের টাকার ভাগ নিয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এতদিন ধরে অনিয়ম চললেও প্রশাসন আগে কেন ব্যবস্থা নেয়নি।