সোহেল রানা রাজশাহী বিভাগীয় প্রধান
রাজশাহী মহানগরীতে আবারো বেসামাল হয়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাসী হামলা, চাঁদাবাজি, মাদক বিক্রি ও মাদক গ্রহণ ছাড়াও তারা চুরি ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের তারা উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানি করছে।
বছর দুয়েক আগে মহানগরীতে পাঁচ শতাধিক কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যের ডাটাবেজ তৈরি করেছিল পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট; কিন্তু পুলিশের নজরদারির অভাবে এলাকাভিত্তিক গড়ে ওঠা বিভিন্ন কিশোর গ্যাং আবারও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নগরী। নতুন নতুন গ্রুপও তৈরি হচ্ছে। ছিনতাই ও ছুরিকাঘাত যেন নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি দল বেঁধে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে উল্লাস নৃত্যও করছে তারা।
কিশোর ছিনতাইকারীদের কারণে বিশেষ করে ভোরবেলা ও রাতের রাজশাহী আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এতে নগরবাসীর মধ্যে তৈরি হয়েছে নতুন আতঙ্ক।
মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্রসহ কিশোর গ্যাংয়ের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ভুক্তভোগী নগরবাসীর অভিযোগে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরী পাড়া-মহল্লায় কিশোর গ্যাং ভয়ংকর হয়ে উঠছে। সন্ধ্যা হলেই এসব কিশোর দলবেঁধে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে সড়কে নেমে পড়ে। বিভিন্ন সড়কে মোটরসাইকেল রেসে তারা লিপ্ত হচ্ছে। পথচারী নারীদের শাড়ি ওড়না ধরে তারা অহরহ টান দেয়। সুযোগ পেলে তারা ছিনতাইও করে। শুধু তাই নয়, প্রতিটি গ্রুপের হাতেই রয়েছে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র।
সম্প্রতি নগরীর শাহ মখদুম থানার গাংপাড়া এলাকায় প্রতিপক্ষের আরাফাত নামে এক কিশোর হামলা চালিয়ে মারাত্মক আহত করে অস্ত্র উঁচিয়ে নৃত্য করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, বাদ্যের তালে তালে চাইনিজ কুড়াল, ধারাল ছুরি, রাম-দা ও অন্য দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কিছু কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নৃত্য করছে।
মঙ্গলবার রাতে এই ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়। এরপরই পুলিশ তাদের চিহ্নিত করতে মাঠে নামে।
এদিকে ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর মঙ্গলবার রাতভর অভিযানে নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সাত কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেফতার করে আরএমপির শাহমখদুম থানা পুলিশ।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- রফিকুল ইসলাম সম্রাট (২১), নাজমুস সাকিব আবির (২১), মোহাইমিনুল শেখ (২০), জিসাদ (২০), সোহেল রানা (২১), মনিরুল ইসলাম অপূর্ব (২২) ও মারুফ হোসেন (২১)। এরা সবাই নগরীর শাহমখদুম থানা এলাকার বাসিন্দা।
পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা বিভিন্ন অপরাধ খতিয়ানের তথ্য জানিয়েছে। ভয়ংকর এই গ্রুপটি রাজশাহীর আমচত্বরসহ আশপাশের সড়কে নানাবিধ অপরাধ করে আসছিল বলে পুলিশ জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ও পাড়া-মহল্লায় নানা নামে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ানক সব গ্রুপ। এদের একটি গ্রুপ টেন স্টার বয় গ্রুপের ব্যাপক নাম ডাক রয়েছে। চলতি বছরের ২ মে চন্দ্রিমা থানার ছোট বনগ্রাম পশ্চিম পাড়া এলাকায় এই গ্রুপের হামলায় ৪ জন যুবক গুরুতর আহত হন। এ ঘটনায় আসাম কলোনি রবের মোড় এলাকার প্রেম (২০), শিশির (১৮), বাবু (১৯) ও ইমনের (২১) বিরুদ্ধে চন্দ্রিমা থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়।
সিয়াম নামে এক কিশোরের সঙ্গে টেন স্টার গ্রুপের প্রধান প্রেম নামের এক কিশোরের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে তর্কবিতর্ক হয়। এর জের ধরে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে সিয়াম আকাশ, সোহান ও মাহিমকে কোপায়।
স্থানীয়রা জানায়, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা এলাকায় ডাব চুরি থেকে শুরু করে পোলের তার চুরি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে ছিনতাইয়েও জড়িত। এছাড়া স্কুলে পড়ুয়া মেয়েদের উত্ত্যক্তসহ এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে চলেছে। এদের হামলার শিকার হয়ে অনেকে ভয়ে মুখ খুলতে চায় না। এই বয়সেই তাদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত। অনেক অস্ত্র হাতে নিয়ে ছবি তুলে এবং ফেসবুকে আপলোড দেয়।
অভিযোগ রয়েছে, এদের বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। এদের পৃষ্ঠপোষকতায় আছেন রাসিকের কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলরও। তাদের ছত্রছায়ায় নানা অপরাধের সাথে লিপ্ত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব গ্রুপের সদস্যরা বেশিরভাগ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তান। শহরজুড়েই কিশোর গ্যাং এর হামলার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।
জানা গেছে, রাতের নগরী বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। রাত ১১টার পর বিভিন্ন সড়ক ও মোড়ে মোড়ে ওতপেতে থাকে। সুযোগ পেলেই তারা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছিনতাই করছে। ভোরে ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে আসা যাত্রীরাই ছিনতাইচক্রের প্রধান টার্গেট। এ সময়টাই ছিনতাইকারী দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বেড়েছে।
গত ২৯ অক্টোবর রাতে রাজশাহী রেলস্টেশন এলাকায় সশস্ত্র ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন দুই কলেজছাত্র কৌশিক ও অভিজিৎ। ছিনতাইকারীদের ধারাল অস্ত্রের আঘাতে তারা দুজনই হাসপাতালে ভর্তি হন। কৌশিকের বুকে ৫০টি এবং অভিজিতের বুকে ৩০টি সেলাই দিতে হয়েছে।
জানা গেছে, গত ১৭ সেপ্টেম্বর দিনের বেলায় নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের আঘাতে মাথায় গুরুতর আঘাত পান রাজশাহী কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নিশাদ আকরাম রিংকু। ১৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পঞ্জা লড়ে গত ৩ অক্টোবর তিনি মারা যান।
চলতি বছরের ৭ এপ্রিল ছিনতাই করে পালানোর সময় অনিক (১৯) নামের এক কিশোর নগরীর ডাবতলা এলাকায় মোটরসাইকেলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। এ ঘটনায় তার আরেক সহযোগী মারুফ হোসেন (১৮) মারাত্মক আহত হয়।
সম্প্রতি নগরীতে চুরি, ছিনতাই ও কিশোর অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হবিবুর রহমান বলেন, বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। বিশেষ করে ১৬-২২ বছর বয়সীরাই এই চক্রের বেপরোয়া সদস্য। এই বয়সে তারা হিরোইজম দেখাতে চায়। এজন্য নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। প্রশাসন ও জনপ্রিতিনিধিদের দায়িত্ব এদের সুপথে ফিরিয়ে আনা।
সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান ঘটেছে বলে স্বীকার করেছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) বিজয় বসাক। তিনি বলেন, দেড় বছর আগে কিশোর গ্যাংয়ের প্রায় ৫০০ সদস্যের ডিজিটাল ডাটাবেইজ তৈরি করা হয়েছিল। তবে এখন এই সংখ্যা অন্তত ৬৫০। বিভিন্ন এলাকায় নতুন নতুন গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। তবে তাদের ওপর পুলিশের কড়া নজরদারিও রয়েছে। কোনো অপরাধ করে কেউই পার পাবে না। এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ারও।