সোহেল রানা রাজশাহী বিভাগীয় ব্যুরো প্রধান
থমকে আছে রাজশাহী মহানগরীর তিন হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। নগরবাসীসহ বাইরে থেকে এ নগরীতে আসা মানুষরাও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কিন্তু এ থেকে যেন বের হতেই পারছে না নগর সংস্থা। বরং চলমান উন্নয়নকাজ শেষ হওয়া নিয়েই দেখা দিয়েছে শঙ্কা। কোনো কাজের অর্ধেক বা তারও বেশি টাকা এরই মধ্যে উত্তোলন করে পালিয়ে গেছেন ঠিকাদার। কিন্তু কাজ শেষ হয়নি এখনো। এ নিয়ে ঠিকাদারের সঙ্গে চলছে নগর সংস্থার রশি টানাটানি। বিশেষ করে নগরীর অলি-গলির রাস্তা এবং ড্রেনের কাজ শেষ না হওয়ায় বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন নগরবাসী। আর নগরীর তালাইমারী থেকে কাটাখালি পর্যন্ত ৬ লেনের রাস্তাটির কাজ শম্বুক গতিতে চলার কারণে এ রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন চলাচলকারী লাখ লাখ মানুষ পড়ছেন ভোাগন্তিতে। ঘটছে প্রাণহানীসহ ছোট-বড় দুর্ঘটনাও।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন সূত্র মতে, ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে তিন হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। এরমধ্যে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার দরপত্র আহŸান করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় গোটা নগরীর ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণের জন্য ১৮৭ কোটি ৫২ লাখ টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে ঢাকার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তানভীর কনস্ট্রাকশনকে। ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ পাওয়ার দুই মাস পর তারা কাজ শুরু করলেও মাস ছয়েক পরেই আবার বন্ধ করে দেয়। গোটা নগরীতেই অর্ধেক কাজও শেষ করতে পারেনি তারা। এরই মধ্যে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর তা বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। পরবর্তিতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কাজের মেয়াদ আবারো বাড়িয়ে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। সেটিও শেষ হয়েছে এরই মধ্যে। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩০ শতাংশ। কিন্তু আর কাজ শুরু করতে পারেনি ওই প্রতিষ্ঠানটি। তবে যে কাজ করেছে, তার মধ্যে ৪৬ কোটি টাকা বিল তুলে নিয়েছে তানভীর কন্সট্রাকশন।
নগরীর তেরোখাদিয়া আবরার মসজিদ থেকে উত্তরপাড়া পর্যন্ত রাস্তাটির ড্রেনের অর্ধেক কাজ করে ফেলে রাখা হয়েছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। ওই রাস্তাটিও খানা-খন্দকে ভর্তি। এতে করে এদিক দিয়ে চলাচলকারী শত শত নগরবাসী প্রতিদিন পড়ছেন ভোগান্তির মুখে। ওই এলাকার বাসীন্দা নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘ঠিকাদার কাজ ফেলে নাকি চলে গেছে। আর কাজ শেষ না করতে পারায় আমাদের কষ্ট হচ্ছে যাতায়াত করতে গিয়ে। একটু বৃষ্টি হলে কাদাপানিতে ভরে যাচ্ছে রাস্তা। এভাবে আর কতদিন কষ্ট করতে হবে বুঝতে পারছি না।’
ওই এলাকার বাসিন্দা ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ভোগান্তির শিকার হওয়া প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ফোন করছে। কিন্তু কোনো সমাধান করে দিতে পারছি না। মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। ঠিকাদারের কারণে আমাদেরও গালিগালাজ শুনতে হচ্ছে।’
একই প্রকল্পের আওতায় মহানগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের চৌদ্দপাই এলাকায় একটি ড্রেন নির্মাণ শুরু করে এখনো শেষ করতে পারেনি একই প্রতিষ্ঠান। এছাড়া মির্জাপুর পশ্চিমপাড়া, মির্জাপুর হিন্দুপাড়া, পশ্চিম বুধপাড়া এলাকাতেও ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণের কথা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নগরীর বুধপাড়া এলাকার বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, ‘বছরের পর বছর আমাদের এই রাস্তাটার জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শুনেছি, ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদার কাজ করতে আসেনি এখনো।’
৩০ নম্বর ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর আলাউদ্দিন বলেন, ‘এই ওয়ার্ডে কাজের জন্য বরাদ্দ ১০ কোটি টাকারও বেশি। এতদিন ধরে ঠিকাদার এক কোটি টাকারও কাজ করেনি।
এদিকে গতকাল সোমবার নগরীর তালাইমারী-কাটাখালি রাস্তা ঘুরে দেখা গেছে, ৬ লেনের এই রাস্তাটির কাজ এখনো অর্ধেকও শেষ করতে পারেনি। আবার পুরো রাস্তাটির কার্পেটিং তুলে ফেলায় অধিকাংশ স্থানেই বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে যানবাহন চলছে জীবনের ঝূঁকি নিয়ে। এ অবস্থায় ঘটছে প্রাণহানীসহ প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনা। মাস দুয়েক আগে এ রাস্তায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন স্বামী-স্ত্রী।
এ রাস্তাটি রাজশাহী শহরে প্রবেশ এবং বাহির হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা-রাজশাহীগামী দূরপাল্লার বাসসহ সব ধরনের যাত্রবাহী ও মালবাহী যানবাহন চলাচল করে রাস্তা দিয়ে। প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহনে লাখ লাখ মানুষ চলাচল করতে গিয়ে খানা-খন্দকের কারণে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে তাদের।
এ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী অটোরিকশা চালক নাজমুল হোসেন বলেন, ‘প্রায় দেড় বছর ধরে রাস্তাটির কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। যার কারণে খুব কষ্ট হয় আমাদের এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে।’
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার জানান, নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে গলির রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণেরর জন্য দু’দফা মেয়াদ বাড়িয়েও কাজ হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে ঠিকমতো কাজ করা যাচ্ছে না বলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সময় অজুহাত দেখিয়েছে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৪৬ কোটি টাকা বিলও পেয়েছে। তাও তারা কাজ শেষ করছে না। বার বার চিঠি দিয়েও কাজ শুরু করছে না এখন। বাধ্য হয়ে আমরা বিকল্প পন্থা ভাবছি।’
তিনি আরও জানান, ‘৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে এ রাস্তাটি প্রসস্তকরণ কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের ২১ অক্টোবর। সেই হিসেবে চলতি বছরের জুনে কাজটি শেষ হওয়ার কথাছিল। কিন্তু ধিরগতিতে কাজ করার কারণে এখনো অর্ধেক কাজও শেষ হয়নি। তবে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর মধ্যেও শেষ হবে বলে মনে হয় না। যদিও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মীর আক্তারকে এরই মধ্যে ৫৫ কোটি টাকা বিলও পরিশোধ করেছে রাজশাহী নগর সংস্থা