অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম।
জীবনের জমা খরচের ঘরে মায়ের কি সঞ্চয়? উত্তরটি কারো মাথায় আছে কি জামা? আছে, কিন্তু কেউ উত্তর দিবে না। সত্যি কথা বলতে কি, মায়ের কোন সঞ্চয় নেই। নেই কোন মূল্যায়ন। তার পরিশ্রমেরও সম্মানী নির্ধারিত নেই। থাকলে অন্তত পক্ষে জাতীয় বাজেটে প্রতিফলন দেখা যেতো তার । নারীর ঘর নাই, বাড়ী নাই, নাই কোন ঠিকানা। জন্মের পর সে বাবার ঠিকানা ব্যবহার করে, বিয়ের পর স্বামীর ঠিকানা।স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানের — এই তিনটা ঠিকানা থাকলেও, আপন ঠিকানা নেই নারীর। কি নির্দয় পরজীবি প্রাণীর ন্যায় নারীর জীবনব্যবস্থা।
একটি কুমারী মেয়ে স্বপ্ন চোখে মেখে, দুরু দুরু বুকে ভয় আতংকের বাসর ঘরে ঢোকে। সেই থেকে শুরু হয় স্বামীর ঘরে বসবাস।বাবার বাড়ীতে ফেলে আসে স্নেহ আদরের বাবা মার ভালাবাসা,বই, খাতা,খেলার পুতুল, জুতা,স্যান্ডেল, খাবার ঘটি বাটি। হাতে রাখি বেঁধে, মেহেদির নকশা আঁকা, গায়ে হলুদ মেখে,পাযে আলতা, আনন্দ উল্লাস করে বিদায় দেয় মেয়েটিকে শ্বশুর বাড়িতে। বলা হয় চিরদিনের মত এটাই তোমার ঠিকানা। মেয়েরা তাই মেনে নেয় ও নিতে বাধ্য হয়। তখন সে হয়ে যায় রান্না ঘরের রাঁধিকা, স্বামীর জৈবিক ক্ষুধা নিবারণে বাসরের ফুল হাতে,শিহরণে কাঁপতে থাকে সারা অঙ্গ, প্রজাপতির পাখনায় ভর করে ঘুরে স্বপ্নের জগতে।দু’চোখে যা দেখে তাই বিস্ময় ও মধুর মধুর লাগে।
মেয়েটির জঠরের ছোট ঘরে যেদিন শুক্রকিট ও ডিম্ব কোষ দলা পাকায়,ভ্রুণ ফোটায়, সেদিন থেকে রঙে রঙে পৃখিবী পাল্টে যায়।স্বামী জড়িয়ে ধরে স্ত্রীকে বলতে থাকে তুমি আমার ষোল আনার জীবন। চোখে চোখ রেখে হারিয়ে যায় অন্য জগতে। স্ত্রীর শারিরিক জটিলতা ক্রমান্নয়ে বাড়তে থাকে। যে মা হয় নাই সে বুঝবে না, সেই মরণ লড়াইয়ের মাতৃত্বকালিন সময়ের যন্ত্রণা। প্রায় দশ মাসের কাছা কাছি সময়ে পৌঁছে, সোনার টুকরো সন্তাটি জঠর থেকে লাফিয়ে আসে পৃথিবীতে। চিৎকার দিয়ে বলে -কোলে তুলে নাও,খাবার দাও। শুরু হয় অন্য জগতের লড়াই।বুকের স্তন চুষতে চুষতে, নাকে মুখে হাত নড়াচড়া করতে করতে মা সন্তানের মধ্যে তৈরী হয় মধুময় সখ্যতা। সন্তানকে কখন খাওয়াবে,গোসল করাবে, আরো প্রাত্যহিক জীবনের নানা কর্মব্যস্থতা। কাজের চাপে মা বুঝতে পারে না, কখন কাঁচা রোদ ছড়িয়ে সূর্য ওঠে ও লালিমা মেখে পশ্চিমে হারিয়ে যায়।
হাটি হাটি পা পা করে সংসার জীবন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলে সন্মুখে। আরো সন্তান যুক্ত হয়,পরিধি বাড়ে,ব্যাস্ততা, সুখ, দুঃখ, ব্যথার সংযোজন ঘটে। টক ঝাল মিষ্টি পারিবারিক জীবনে, নানা ক্রাইসিস চূলের জটা পাকায়, নিত্যদিনের হাড়ি পাতিলের আওয়াজে উত্তাপ বাড়ে কমে। সন্তান, স্বামী, শ্বশুর,শ্বাশুরি,পরকাল, ইহকালের বন্দনা করতে গিয়ে নারী তার ঘর্মাক্ত জীবনে নিংশ্বাস ফেলার সময় পায় না। কর্মজীবি হলে তো জীবন কয়লা হয়ে যায়,চার হাত পা বাড়িয়ে দিয়ে কাজ করতে করতে। অফিসের বড় কর্তা, স্বামী সন্তান কেউ ক্ষমা করে না, কাজে ব্যাঘাত ঘটলে। স্মামী তার ক্লান্তি দূর করতে এক কাপ চা এর জন্য বাড়িয়ে রাখে হাত স্ত্রীর দিকে। বাচ্চারা মজার মজার খাবার মায়ের হাত থেকে পাবে, সে প্রত্যাশা করতেই থাকে।অথচ মায়েরও যে অসুখ বিসুখ হতে পারে, ক্লান্তি যে তারও শরীর চায়, সে দিকে কে রাখে চোখ। কেউ কেউ রাখে মায়ের খোঁজ, তবে তা সংখ্যাগত হারে খুবই কম।এ ভাবেই ঘুরছে তো ঘুরছে পারিবারিক ও সামাজিক জীবন চিত্র।
কোন কারণে স্বামী স্ত্রীতে ভুল বোঝা বোঝি হতে পারে। এক জনের মুখ দক্ষিণে, আর একজনের মুখ উত্তরে ১৮০ ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুরিয়ে রাখতে পারে।এমন কি চলে যা বাপের বাড়ী এই বলে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ী থেকে বেড় করে দিতে পারে স্বামী তার স্ত্রীকে। ইচ্ছে করলে স্বামী তার স্ত্রীকে ডির্ভোসও দিতে পারে। রেজিষ্ট্রেশান করে বিয়ে যদি না হয়, রেজিষ্ট্রেশান করে হলেও কাবিন নামার ১৮ নং কলামের শর্ত পুরণ না করলে অভাগা স্ত্রী ডির্ভোস দিতে পারে না,বিধিগত জটিলতার কারণে। আবার স্বামীর বিয়েও ঠেকাতে পারে না।
এই মাত্র (২২ /৫/২৫) টিভিতে দেখলাম একজন স্বামী একে একে তিনটা বিয়ে করেছে,। তিন স্ত্রী স্বামীকে নিয়ে করছে টানাটানি।স্বামী লাঠি হাতে নিয়ে তাদের ভয় ভীতি দেখাচ্ছে।তিন স্ত্রীর জ্বালা যন্তণা সহ্য করতে না পেরে, তাদের ডির্ভোস দিয়ে আরো একটা বিয়ে করে। সস্মানিত পাঠক, এটা তো নাটক এই বলে উড়িয়ে দিবেন না। নাটক তো আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিফল।এই সমস্ত অনিয়মের জঞ্জাল পরিস্কার করবে কে। বিধি বিধান প্রণীত হলেও, লাল ফিতার ফাইলে বন্দি হয়ে পড়ে আছে। নারীরা পদে পদে হোচট খেয়েই সংসার করছে।
স্বামী ডির্ভোস দিলে মেয়েটি আশ্রয় নিবে কোথায়।আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে অভাব অনটন লেগেই থাকে।তৃণমূল পরিবারের অবস্থা আরো করুণ। তারা নিজেরাই চলতে পারে না।তখন ডির্ভোসি নারীকে রাস্তায় নেমে আসা ছাড়া গতি থাকে না।আবার ডির্ভোসী নারীকে স্বামী গৃহ ত্যাগ করতে হয় শুধু পড়নের শাড়ী ব্লাউজ সঙ্গে নিয়ে। এমন কি জঠর নিসৃত সন্তানও নিয়ে আসতে পারে না।সন্তানের মালিকানা সত্ব বাবার।তবে যে সমস্ত বাবা চালাক, ও দুরন্ধর প্রকৃতির, তারা সন্তানদেরকে মায়ের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে চলে যায় নিরুদ্দেশে।আমি এমন নারীকেও দেখেছি –একটা সন্তান হাতে,আর একটা কোলে ও পেটে নিয়ে তৃতীয় সন্তান, ডিভোর্স লেটার হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে। কাবিন নামার টাকা, ভরণ পোষণের খরপোষ দেবার ভয়ে স্বামী গা ঢাকা দেয়। তারপর হয়তো- বা আরো একটা বিয়ে করে পুরুষটি নতুন সংসার সাজায়।এ হেন আবস্থায় কোথায় দাঁড়াবে সেই নারী ? দেহ বিক্রি করলে কি অপরাধী হয়ে যাবে? পেটের আগুন নিবারণ করবে সে কি ভাবে। মা তো বাচ্চাদের ফেলে দিতে পারে না। জমা খরচের ঘরে মায়ের এহেন অবস্থায় কি সঞ্চয় বলুন তো।
মায়ের কোন অর্থনৈতিক মুক্তি নেই।সে চাকুরী করলেও কোন কোন নারী আয়ের টাকা সবটুকুই তুলে দেয় শ্বাশুরি বা স্বামীর হাতে। তার হাত খরচের টাকা চেয়ে নেয় তাদের কাছ থেকে। এ ধরনে যন্ত্রণা আমি নিজের চোখে দেখেছি। মেয়েটির চোখের জল মুচিয়ে অনুরোধ করেছি- র্ধৈয ধর।কিন্তু সংসার ভাংবে না। শত চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারিনি।তবে অনেক নির্যাতনের পর বর্তমানে নারীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে, নিজের অধিকার কড়ায় ঘন্ডায় বুঝে নিচ্ছে বা নেয়ার চেষ্টা করছে। তাতে বাড়ছে স্বামী স্ত্রী কে কেন্দ্র করে নানা জটিলতা।আমি আশাবাদী শিক্ষার হার বাড়লে,দ্র্যারিদ্যতা ঘোচে গেলে জীবন হবে ফুলের মতো প্রবিত্র ও সুখকর। আমরা তো এটাই প্রত্যাশা করি।
কেউ কেউ বলে নারীরা বাবা এবং স্বামীর বাড়ী থেকে অনেক বেশী অর্থ পায়।আসুন তো দেখি কি ভাবে। স্বামী জীবিত কালিন সময়ে স্বামীর রাজ্যত্বের সুখ, বিলাসিতা ভোগ করতে পারবে স্ক্রী।কিন্তু চূল পরিমান সম্পদের মালিকও স্ত্রী নয়।স্বামী মারা গেলে ষোল আনার দু’আনা পাবে। অন্যদিকে বাবা মারা গেলে ভাইয়ের অর্ধেক অংশ পাবে বোন। তবে সে অংশ যদি ভাই বা ভাইয়েরা দেয় তাহলে পাবে।বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বোনকে বাবার বাড়ীর ওয়ারিশি দেয় না।আমার মা তার বাবার ওয়ারিশি পায় নাই।তবে আমার বাবাকে তার বোন একটা তজবী, একটা জায়নামজ ও এক খান কোরআন শরীফের বিনিময়ে দান করে দিয়েছেন তার বাবার বাড়িতে পাওয়ানা ওয়ারিশ। দান পত্রটি পড়ে আমি অবাক হয়েছি।কারণ এই অভিঞ্জতাটি আমার জানা ছিলো না।
মায়ের কপালে রয়েছে আরো করুণ পরিণতি।বাংলাদেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলো ঘুরে দেখুন,বহু নারীর ছেলে মেয়েরা ভালোভাবে জীবন যাপন করতেছে,কিন্তু মাকে ফেলে রেখেছে বৃদ্ধাশ্রমে। যারা বিদেশ পাড়ি দিয়েছে, তাদের মা বাবার জায়গাও বৃদ্ধাশ্রমে। এই সমাজব্যবস্থায় নারীর কি এই ধরনের অমানবিক অবস্থা, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে কাম্য?
নারী বার্ধ্যকে পৌছে গেলে, ছেলে,মেয়ে,নাতি পুতি দিয়ে ঘর ভরে যায়। মায়ের গুরুত্ব কমে আসতে থাকে। এমন কি হাতে পায়ের শক্তিতেও ভাটা পড়ে। বেঁচে থাকলেও নিজের সক্ষমতা ও কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে। ছেলে মেয়ের কাছে বোঝা মনে হতে থাকে। হাতে টাকা পয়সা না থাকলে, ছেলেরা বুড়ু মাকে শিয়ালের গর্তে ফেলে রেখে আসে। বাসে উঠিয়ে দিয়ে অচেনা গন্তব্যে পাঠিয়ে দেয়।এক বারও ভাবে না সে বুড়ু হলে,এ ধরনের দূর্বিসহ যন্তণার মুখোমুখি হতে পারে নিজেও।বলুন তো মায়ের জমা খরচের খাতায় কি সঞ্জয় জমা রইলো, বিড়ম্বনা ছাড়া।
পরিশেষে বলবো –এ সমস্ত যন্তণা নিরসনের প্রয়োজনের প্রত্যেক গৃহিনীর জন্য মাসিক ভাতা নির্ধান করা উচি সরকারি তত্বাবধানে। যা প্রতি মাসে পরিশোধ যোগ্য হবে। মায়ের এই অর্থের উপর কারো লোভ বা অধিকার থাকবে না।মা তার ইচ্ছে অনুযায়ী খরচ করতে পারবে। সার্ব জনিন পেনশান ক্রীম সরকারী তত্বাবধানে যে ভাবে চালু করা হয়েছে,সে ভাবে হাউজ ওয়াইফদের কর্মের স্বীকৃতি দিয়ে মাসিক সম্মানী ভাতা নির্ধারন করা উচিৎ সরকারি তত্বাবধানে।তা হলে নারীর পায়ের তলার মাটি শক্ত হবে। মায়ের জীবনের মর্যাদা ও সার্থকতা বাড়বে।
কথায় বলে — টাকা থাকলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়। নারীর হাতে টাকা থাকলে দুধের মাছি ভন ভন করবে।তাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে না। শুধু বেহেশতের চাবি নয়,সেবার চাবিও লুটোপুটি করবে পায়ের কাছে।
লেখকঃ উপদেষ্ঠামন্ডলির সদস্য,বাংলাদেশ কৃষকলীগ।
০১৭১৭৭৬২৭৪৫