হুমায়ূন রশিদ জুয়েল কিশোরগঞ্জ :
কিশোরগঞ্জ জেলা একটি প্রসিদ্ধ স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী জেলা যেখানে রয়েছে অনেক নান্দনিক দৃশ্যপট, কালের বিবর্তনে,
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মডেল মহিনন্দ ইউনিয়নের কাশোরারচর বিলের পাশ দিয়ে এক যুগ আগেও পানির উপরে শুধুই কচুরিপানা দেখা যেত। এখন সেই কচুরিপানার মধ্যে বিষমুক্ত বিভিন্ন শাকসবজির পরিপাটি বাগান দেখে যে কারও চোখ জুড়িয়ে যাবে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, পানিতে কোনো সবুজ গালিচা বিছানো।সেই নান্দনিক দৃশ্যপট দেখতে দূর দূরান্ত থেকে প্রতিদিনেই ছুটে আসছেন পর্যটক ও ভ্রমণকারীরা।
কৃষি বিভাগের মাধ্যমে স্থানীয় চাষিদের প্রশিক্ষিত করে এই বিলের কচুরিপানার ওপর চাষ করা হয় সবজি। ভাসমান সবজি চাষে দিন বদলে গেছে কৃষকদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিলের এক একর পরিমাণ জায়গায় পানির ওপর কৃষকরা তৈরি করেছেন ২২০টি বেড। প্রত্যেকে কাজ বণ্টন করে নিয়ে সবজি বেডের পরিচর্যা করেন। কেউ নৌকা নিয়ে, কেউ পানিতে নেমে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন। আর এভাবে বিষমুক্ত সবজি চাষে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা।
সবজি চাষে প্রায় ২৫টি পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে জানিয়ে কৃষকরা বলেন, তাদের দেখাদেখি জেলার অন্যান্য উপজেলার কৃষকদের মধ্যে ভাসমান সবজি চাষে উৎসাহিত হয়ে আগ্রহ বাড়ছে। কিশোরগঞ্জ জেলার আশপাশসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার চাষি ও কৃষি গবেষকরা এই বিলের ভাসমান সবজি চাষ দেখে আপ্লুত। বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করে চাষিদের পুরস্কৃত করেছেন।
জানা গেছে, ‘ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা ফসল চাষ, গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের আওতায় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি অফিস এ বছর মহিনন্দ ও কলাপাড়া ব্লকে ৭৩টি প্রদর্শনী বাস্তবায়িত করেছে। এরই অংশ কাশোরারচর বিলের ভাসমান সবজি বাগান।
কৃষি বিভাগ কালের নতুন সংবাদকে জানায়, ভাসমান বেডে সবজি চাষ প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫০টি। মহিনন্দ ব্লকে বাস্তবায়ন করেছে ১২টি, কলাপাড়া ব্লকে ২৮টি। চলমান রয়েছে ১০টি মসলা প্রদর্শনী। ফ্লিপ প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ২০টি, এর মধ্যে ২০টিই কলাপাড়া ব্লকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ময়মনসিংহ নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের বরাদ্দ তিনটি বাস্তবায়ন করা হয় কলাপাড়া ব্লকে। সব মিলিয়ে ৭৩টি প্রদর্শনী এ বিলে বাস্তবায়িত হয়েছে।
২০১২-১৩ অর্থবছরে এই বিলে সদর উপজেলা কৃষি বিভাগের মাধ্যমে প্রকল্পটি শুরু হয়। প্রথমে চংশোলাকিয়ার হারিছ উল্লাহ, ফয়েজ উদ্দিন, নুরুল ইসলাম, মজলু, মফিজ ভাসমান বেডে সবজি আবাদ করেন। বর্তমানে ২৫টি পরিবার বিলের ১ একর জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি আবাদ করেছেন। কৃষি বিভাগ বলছে, ভাসমান বেডে ৭ থেকে ১০ মেট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয়েছে।
চংশোলাকিয়া এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ উদ্দিন, নুরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন কৃষক কাশোরারচর বিলের পতিত ভূমিতে এক যুগ ধরে ভাসমান বেডে সবজি চাষ করে আসছেন। তারা জানান, ভাসমান বেডের সবজি বিক্রির টাকায় তাদের পরিবার-পরিজনের ব্যয় নির্বাহ করতে পারছেন। তাদের সাথে এখন মফিজ উদ্দিন পাঠান, রাজীব মিয়া, রুহুল আমিন, রোকন মিয়াসহ অনেক কৃষক সবজি আবাদ করেন।এছাড়াও ভোরের আকাশকে জানান, আমাদের আর্থিক সচ্ছলতার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তারা জানান, তাদের নিজস্ব জমি নেই। কৃষি অফিসের সহায়তায় হাজামজা বিলে ভাসমান বেডে শাকসবজির চাষ করেন। কৃষি অফিস বীজ, সেক্স ফেরোমন ফাঁদ, প্লাস্টিকের নৌকাসহ উপকরণ দিয়ে সহায়তা করেছে। ফলে ফলন ভালো হওয়ায় তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
কলাপাড়া ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উম্মে কুলসুম জেবুন্নেছা বলেন, তিনি প্রথমে চংশোলাকিয়া এলাকার দুজন কৃষক ফয়েজ উদ্দিন ও নুরুল ইসলামের মাধ্যমে কয়েকটি পরীক্ষামূলক বেড তৈরি করান। এতে ফলন ভালো হওয়ায় বর্তমানে চাষি ও বেডের সংখ্যা বেড়েছে।
মহিনন্দন ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. নাছিরুজ্জামান সুমন বলেন, ‘আমার ব্লকে কাশোরারচর বিলে ১২টি বেডে সবজি আবাদ করা হয়েছে। কৃষকদের ঐ ভাসমান বেডে সবজি চাষ করতে যে উপকরণগুলো প্রয়োজন সব উপকরণ সামগ্রী প্রদান করা হয়েছে এবং সফলতার সাথে বাস্তবায়ন হয়েছে এছাড়াও কৃষকগণ আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন।
বিলে ভাসমান সবজি চাষ প্রথম শুরু হয় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার সাবেক কৃষি অফিসার বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. মনিরুল ইসলামের সময়। তিনি বলেন, ‘আমি যখন সদরের কৃষি অফিসার ছিলাম, তখনই এ প্রকল্পটি চালু হয়েছিল। শুরুর সময় চাষি ফয়েজ উদ্দিনকে আমার সময়েই কৃষি বিভাগ পুরস্কারে ভূষিত করে। মিডিয়ার মাধ্যমে এ বিলের ভাসমান সবজি চাষের সফলতা দেখে ভালো লাগে।’
মহিনন্দ ইতিহাস ওইতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি গবেষক আমিনুল হক সাদী বলেন,ভাসমান সবজি চাষ আমাদের ইউনিয়নের একটি গর্বই না সারা দেশের জন্য গর্ব বলে আমি মনে করি। ।কারণ এখানে গবেষক দল এসে রিসার্চ করে, বিভিন্ন কৃষি মন্ত্রনালয়ের সহ দেশের বিভিন্ন জেলার চাষীরাও দেখতে আসেন। এ প্রকল্পটি অব্যাহত থাকলে দরিদ্র চাষীরা উপকার পাবে স্বাবলম্বী হবে স্থানীয়রাই।
কাশোরারচর বিলে বহু বছর ধরে অনেক জমি পতিত ছিল। সেসব ভূমিতে কৃষি বিভাগের সহায়তায় কৃষকদের প্রশিক্ষিত করে ভাসমান বেডে সবজি আবাদ করা হয়।
এছাড়াও এ বিষয়ের কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা উদ্ভিদ সংরক্ষণ উপসহকারী কর্মকর্তা মোঃ আবুল হাশেম জানান, এই ভাসমান প্রকল্প প্রদর্শনী অত্যন্ত সফলতার সাথে বাস্তবায়ন হচ্ছে পাশাপাশি দরিদ্র কৃষক পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি অফিসার ফাহিমা আক্তার ফাহিম কালের নতুন সংবাদ কে জানান,
, ভাসমান সবজি প্রদর্শনী সাত মাসের প্রকল্প। বর্তমানে ৫ মাস চলমান। এরই মধ্যে আশাতীত ফল পাওয়া যাচ্ছে। জমির শাকসবজি অতিবর্ষণ, বর্ষা ও খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ভাসমান বেডের শাকসবজির কোনো ক্ষতি হয় না। ফলে জমির শাকসবজির যখন আকাল দেখা দেয়, তখন ভাসমান বেড থেকে বাজারে শাকসবজির জোগান পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে শাকসবজি আবাদ করে কৃষকরা দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি স্বাবলম্বী হচ্ছেন।