। দুধরচকী।
বিশ্বাস ও কর্মের দৃষ্টিতে মহাগ্রন্থ আল কোরআন মানুষকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছে। একদল মুমিন অর্থাৎ বিশ্বাসী, অপরদল কাফির অর্থাৎ অবিশ্বাসী। বিশ্বাস হচ্ছে কর্মের ভিত্তি এবং কর্মের মাধ্যমেই একজন মানুষের চরিত্র ফুটে ওঠে। সে কারনে সমাজে ভাল মানুষ সৃষ্টির লক্ষ্যে ইসলাম মানুষের বিশ্বাসগত দিকটির প্রতি প্রথমেই দৃষ্টি দিয়েছে এবং ইসলামের কতগুলো মৌলিক বিষয়ে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেন তাদেরকে মুমিন বলে উল্লেখ করেছে। কোরআনের সকল পাঠকই এ পরিভাষার সাথে অত্যন্ত পরিচিত। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মুমিন কারা, কি তাদের বৈশিষ্ট্য সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারনা আমাদের না থাকায় ঈমানের সুফলতা থেকে যেমন আমরা নিজেরা বঞ্চিত হচ্ছি তেমনি অন্যদেরকেও আমাদের বিশ্বাস ও কর্মের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারছি না।
রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে মুমিনদের উদ্দেশ্যে নাজিল করা আয়াত সমূহে তাদের বিশ্বাস, কর্ম, করণীয় ও বর্জনীয় এবং গুণাবলি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। যার জ্ঞান আমাদের ঈমানী চেতনাকে জাগ্রত করতে পারে। প্রথমেই কোন কোন বিষয় গুলোর উপর একজন মুমিন বিশ্বাস স্থাপন করবে তা কোরআন বলে দিয়েছে। যেমন কোরআন থেকে কারা হিদায়াত পাবে সে বিষয়ের উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, “যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে তারা খরচ করে। আর তোমার ওপর যে কিতাব নাজিল করা হয়েছে এবং তোমার আগে যে সব কিতাব নাজিল করা হয়েছিল সে সব গুলোর ওপর ঈমান আনে এবং আখেরাতের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে। এ ধরনের লোকেরা তাদের রবের পক্ষ থেকে দেওয়া হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারা কল্যাণ লাভেরও অধিকারী” (সুরা বাকারা: ৩-৫)। অন্যত্র বলা হয়েছে-“বরং নেক কাজ হচ্ছে তো এই যে, মানুষ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা আল্লাহর কিতাব ও নবীদেরকে মনে প্রাণে মেনে নেবে।” (সুরা বাকারা: ১৭৭)
এ ছাড়াও বলা হয়েছে, “রাসুল তার রবের পক্ষ থেকে তার ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছেন। আর যেসব লোক রাসুলের প্রতি ঈমান এনেছেন তারাও ঐ হিদায়াতকে মনে-প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছেন। তারা সবাই আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে, তাঁর কিতাব সমূহকে ও তাঁর রসুলদেরকে মানে এবং তাদের একজনকে আর একজন থেকে পৃথক করে দেখেন না, আর তারা বলেন আমরা শুনলাম এবং অনুগত হলাম। হে আমাদের রব আমাদের ক্ষমা করুন, আপনারই নিকট আমাদের ফিরে যেতে হবে।” (সুরা বাকারা: ২৮৫)
উপরিউক্ত আয়াত সমূহ থেকে সার সংক্ষেপ যা জানা যায় তাহলো, “মুমিনগণ মৌলিক ভাবে আল্লাহ, রাসুল, ফিরিশতা, কিতাব ও আখিরাতে বিশ্বাস স্থাপন করবেন। এ বিশ্বাস তাদের কি মানের হতে হবে সে বিষয়ে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই যারা এ কথার ঘোষণা দিয়েছে যে, আল্লাহই আমার রব এবং তার উপর সুদৃঢ় থাকবে তার জন্য ফিরেশতা অবতীর্ণ হবে” (হা-মীম আস-সিজদা: ৩০)। আরও বলা হয়েছে যে, “মুমিন তো হলো তারাই যারা আল্লাহ ও রাসুল (সা.) এর উপর ঈমান আনার পর কখনো তাতে সন্দেহ পোষণ করেনি বা তা থেকে ফিরে যায়নি” (সুরা হুজরাত: ১৫)।
এভাবে বিশ্বাসের দৃঢ়তা বা সত্যিকারের ঈমান বুঝবার একটি পরিমাপও মহাগ্রন্থ আল-কোরআন আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। “সত্যিকারের ঈমানদার তো তারাই, আল্লাহকে স্মরণ করা হলে যাদের হৃদয় কেঁপে ওঠে। আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পড়ে শুনানো হয়, তাদের ঈমান তখন বেড়ে যায় এবং তারা নিজের রবের ওপর ভরসা করে” (সুরা আনফাল: ২)। এ তো গেলো সত্যিকারের মুমিনের পরিচয়। এবার সফল মুমিন কারা তার পরিচয়ে কোরআন কি বলে আমরা সুরা মুমিনুনের প্রথম কয়েকটি আয়াত সামনে আনলে তা দেখতে পাই।
“যারা ভীতি ও বিনয় সহকারে নামাজ আদায় করে” (আল মুমিনুন: ২):
একজন মুমিনের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছে। সুতরাং তিনি অবশ্যই তা আদায় করবেন। বলা হয়েছে যে, “নামাজ কায়েম করো, যাকাত দাও এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো” (সুরা বাকারা: ৪৩)। এ আয়াতের মাধ্যমে মুমিনদেরকে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করার জন্যও তাকিদ দেওয়া হয়েছে। তবে সে নামাজ হতে হবে বিনয় ও ভীতি সহকারে। অর্থাৎ খুশু-খুযূর সাথে সালাত আদায় করবেন। এখানে শুধু নামাজ পড়ার কথা বলা হয়নি বরং ‘খুশু’-এর সাথে নামাজ আদায়ের কথা বলা হযেছে। ‘খুশু’-এর অর্থ হল, বিনয়ের সাথে অন্তরকে আল্লাহর দিকে অভিমুখী করা। ইবাদাত সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, “তোমরা এমন ভাবে ইবাদাত করো যেন আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তোমরা আল্লাহকে দেখতে না পাও অবশ্যই তিনি তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন।” এ ধরনের একটি অনুভূতিই নামাজের মধ্যে কাম্য। কেননা অন্য একটি হাদিসে এভাবে বলা হয়েছে যে, “মুসাল্লি আল্লাহর সাথে কথা বলে” (বুখারি)।
“মুমিনগণ বেহুদা কথা ও কাজ থেকে দূরে থাকে” (আল মুমিনুন: ৩):
মুমিন মনে করে এ দুনিয়া হলো আখিরাতের জন্য চাষাবাদের জায়গা। এখানে সে যত ভাল কাজ করবে আখিরাতে তার সুফল তিনি পাবেন। সুতরাং কোন বেহুদা কথা ও কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার মত তার কোন সময় সুযোগ নেই। সে কারনে অন্যত্র বলা হয়েছে “(মুমিনগণ) কোন বাজে জিনিসের কাছ দিয়ে পথ অতিক্রম করতে থাকলে ভদ্রলোকের মত অতিক্রম করে চলে যায়” (সুরা ফোরকান: ৭২)। অতএব সফল মুমিনদের উচিত বেহুদা কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। একটি হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) সাহাবীগণকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন, “তোমরা বেশির ভাগ চুপ থাকো, কেননা তা শয়তান বিতাড়িত করতে এবং দ্বীনের পথে সকল কাজের জন্য সহায়ক হবে।”
“মুমিনগণ যাকাত তথা পবিত্রতা ও উন্নয়নের জন্য কর্মতৎপর থাকে” (আল মুমিনুন: ৪):
এটি ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। রাসুল (সা.) কে ইতিবাচক যে ৪টি কাজের জন্য পাঠানোর বিষয়ে সুরা বাকারার ১২৯ ও ১৫১, আলে ইমরানের ১৬৪ ও সুরা জুমআর ২ নং আয়াতে বলা হয়েছে সেখানে সফল মুমিনের কাজের বিষয়েই উল্লেখ করা হয়েছে। যাকাত একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। যার মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি, সমাজের সংশোধন ও উন্নয়ন এবং আহলে নিসাবের অর্থের নির্দিষ্ট পরিমাণ আল্লাহ নির্ধারিত খাতে প্রদান সবটাই বুঝায়। তবে এখানে উল্লেখিত আয়াতটি যাকাতের বিধান চালু হওয়ার আগে অবতীর্ণ। সুতরাং তা দিয়ে শুধু অর্থের যাকাত ইঙ্গিত করা হয়নি বরং মুমিনের আত্মশুদ্ধি, সমাজ সংশোধন ও উন্নয়নে