মোহাম্মদ মাসুদ স্টাফ রিপোর্টার
চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকাসহ তীব্র শীতে কাঁপছে সারাদেশ। বাংলাদেশে বর্তমানে স্মরণকালের সবচেয়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ চলছে।তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রিতে নামা নিয়ে সংশয়! সারা দেশেই বইছে শৈত্যপ্রবাহ। বাংলাদেশে ইতিহাসে ৭০বছরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড। শৈত্যপ্রবাহ ও তীব্র শীতে সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় বিপর্যস্ত জনজীবন।
শীতের দাপটে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রিতে নামা নিয়ে সংশয়! তবে তাপমাত্রা কোনক্রমেই ৫ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে না মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের । শীতে বাড়ছে বৃদ্ধ ও শিশুর মৃত্যু। সারা দেশের শীতের ২৯ জনের বেশি মৃত্যু।
চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল উত্তরাঞ্চল ও গ্রামে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না সাধারণ মানুষ। দেশে প্রথম শৈত্যপ্রবাহে জরুরী নির্দেশনা। স্কুল-কলেজ বন্ধে মন্ত্রণালয়ের একদিনে তিন নির্দেশনা মাউশির! তাপমাত্রা ৯.৮ ডিগ্রি, তবু মেহেরপুরে খোলা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে মৃদু শৈত্য প্রবাহ। কনকনে ঠাণ্ডা ও হিমেল হাওয়াতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে চলছে মৃদু শৈত্য প্রবাহ। কনকনে ঠাণ্ডা ও হিমেল হাওয়াতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জনমনে প্রশ্ন এ বছর বেশি শীত অনুভূত হওয়ার কারণ কী?উত্তরে মানুষের সৃষ্ট নানা কারণে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনই মূল কারণ মন্তব্য আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের।
বুধবার দুপুর পৌনে তিনটা পর্যন্ত চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল,উত্তরাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকায় ও গ্রামে সূর্যের দেখা মেলেনি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে না সাধারণ মানুষ।
বর্তমানে টাঙ্গাইল,ফরিদপুর, রাঙ্গামাটি,কুমিল্লা,মৌলভীবাজার,চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়াসহ রংপুর,রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ বিভাগের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। দেশে দ্বিতীয় দফায় মৃদু ও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বইছে।
গত সোমবার দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড পাওয়া গেছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। সেখানে ব্যারোমিটারে তাপমাত্রা ছিল ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ৭০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে সর্বশেষ এত তীব্র শীত পড়েছিল ১৯৬৮ সালে। ওই বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটের শ্রীমঙ্গলে ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এরও ২০ বছর আগে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত এত কম তাপমাত্রার রেকর্ড খুঁজে পায়নি আবহাওয়া অফিস।
দেশের উত্তরাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে অবশ্য পাঁচ দিন ধরে দিনভর ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের অনুভূতি থাকছে। গতকালও রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের বেশির ভাগ এলাকায় শৈত্যপ্রবাহের কাছাকাছি তাপমাত্রা ছিল। কুয়াশা বেশি থাকায় সৈয়দপুর, রাজশাহী ও সিলেট বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামায় সমস্যা হয়েছে। ফেরি চলাচলেও বিঘ্ন ঘটেছে। আর হাসপাতালগুলোতে বেড়ে গেছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের ভিড়। বিশেষ করে শিশুদের কষ্ট ছিল বেশি।জানুয়ারিতে দেশের অর্ধেকের বেশি এলাকাজুড়ে তীব্র শীতের অনুভূতি থাকছে, যা একসময় শুধু উত্তরাঞ্চল ও সিলেটে বেশি দেখা যেত। এতে সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়ে গেছে।
তবে দেশবাসীর জন্য কিছুটা হলেও সুসংবাদ জানাচ্ছে বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি)। সংস্থাটি বলেছে, কাল বুধবার পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি থাকতে পারে। এরপর তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। তখন শৈত্যপ্রবাহ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। তবে শীতের অনুভূতি থাকবে। আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক জানিয়েছেন, সারা দেশে তাপমাত্রা কিছুটা কমবে তবে সেটি পাঁচ ডিগ্রি হওয়ার আশঙ্কা নাই।
এ নিয়ে সাত দিন ধরে চলছে শৈত্যপ্রবাহ। চট্টগ্রামসহ সারা দেশের মানুষ চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে। তবে সোমবারের তীব্র শৈত্যপ্রবাহ যেন বাংলাদেশের মানুষের জন্য চরম রুদ্ররূপ নিয়ে আসে। কেননা, এর আগে এ মাত্রার শীত পড়েনি এ দেশে। ভয়ংকর এ পরিস্থিতিতে মানুষের জবুথবু অবস্থা। অনেকটাই বিপর্যস্ত জনজীবন। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। এই শীতে বেশি ভুগছে বয়স্ক ও শিশুরা। শীতে বোরো এবং আলুর ফলনে প্রভাব পড়েছে। শীতে স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতেও প্রভাব পড়েছে। রাজধানীর কোনো কোনো স্কুলে সময়সূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এদিকে উষ্ণতার জন্য গরম কাপড়ের কদর বেড়েছে। ভিড় দেখা গেছে শীতবস্ত্রের দোকানগুলোয়। বিভিন্ন বয়সের মানুষের শীতজনিত নানা রোগ-বালাইয়ে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে হাসপাতালগুলোয় অসুস্থ রোগীর ভিড় বাড়ছে। শীত ও শীতজনিত রোগে গত সাত দিনে (সোমবার পর্যন্ত) ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু সরকারি হিসাবেই ৬০৬ জন আক্রান্ত হয়েছে।
শীতের এমন রুদ্ররূপকে জলবায়ু পরিবর্তনেরই আরেক কুফল বলে অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে স্মরণকালের সবচেয়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ চলছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায়ও অর্ধশত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শীত পড়েছে। বিপরীত দিকে এখন খরতাপে পুড়ছে অস্ট্রেলিয়া। সেখানে ৪৭ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান সরকার তার নাগরিকদের ঘরের বাইরে যেতে বারণ করেছে। একই সময়ে বিশ্বের আলাদা প্রান্তে আবহাওয়ার এই যে ভিন্ন রূপ, সেটা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই। তাই বিশ্ববাসীকে মিলেই জলবায়ু পরিবর্তনের এ ভয়ংকর পরিণতি থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে হবে। তিনি আরও বলেন, চলতি বছরই আমরা একাধিকবার জলবায়ু পরিবর্তনের রুদ্ররোষে পড়েছি। এবার আগাম বন্যা হয়েছে। এর আগে গ্রীষ্মে তাপমাত্রাও ছিল বেশি। এখন শৈত্যপ্রবাহ অর্ধশত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিএমডির কাছে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত আবহাওয়া ও জলবায়ুর রেকর্ড আছে। এর মধ্যেও (৭০ বছর) সোমবারের মতো তাপমাত্রার রেকর্ড তাদের কাছে নেই।
আরেক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত যুগান্তরকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের প্রধান নিদর্শন হচ্ছে- শীত বা উষ্ণতা যেটাই ধরি না কেন, সেটা সর্বোচ্চ মাত্রায় ঘটবে এবং ঘন ঘন আবির্ভূত হবে। ৫০ বছর পর যদি শীত বেশি এসে থাকে সেটাকে স্বাভাবিক বলতে পারি। কিন্তু এটাই যখন ১০ বা ৫ বছর পর আজকের রেকর্ড ভাঙবে, তখন সেটাকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংঘটিত বলা যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আবহাওয়া বিরূপ প্রভাবের শিকার।
বিএমডির আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ছয় কারণে এই ‘অতি তীব্র’ শৈত্যপ্রবাহ চলছে। উচ্চবলয় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত। তাছাড়া মাঝরাত থেকে দুপুর পর্যন্ত কখনও বিকাল ৩টা পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় আচ্ছাদিত থাকে দেশ। ভূপৃষ্ঠ থেকে আকাশের দিকে প্রায় ২০০ মিটারের একটি কুয়াশাস্তর ছিল। এর কারণে সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে আসতে পারেনি। ফলে ভূপৃষ্ঠ এবং এর সংলগ্ন বাতাসের উষ্ণতা বাড়তে পারেনি। তাছাড়া ভারতের হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের তাপমাত্রা অনেক কম। শীত মৌসুমে সাধারণত ওইসব এলাকা (উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমদিক) থেকে বাংলাদেশমুখী বাতাসের গতি থাকে। সেটাও শীতল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেঘমুক্ত আকাশ। সাধারণত আকাশ মেঘলা থাকলে বিকিরণ প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠ শীতল হতে সময় লাগে। তাপমাত্রা ভূপৃষ্ঠে বেশিক্ষণ থাকতে পারে। ফলে ধরণী শীতল হতে না হতেই নতুন দিনে সূর্যের আগমন ঘটে। ফলে মেঘমুক্ত আকাশ ধরণীকে দ্রুত শীতল করে। পাশাপাশি দীর্ঘ-রজনী সূর্যের আগমন বিলম্বিত করে। এসব কারণ উপস্থিত থাকায় ঊর্ধ্ব আকাশের বাতাসের গতির জেট এক্সট্রিম (শীতল বাতাসের লাইন বা যেখানে তাপমাত্রা জিরো ডিগ্রি) নিচে (ভূপৃষ্ঠের দিকে) নেমে এসেছে। এটা সাধারণত ৬০০-৭০০ হেক্টর স্কেলের মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু সেটি আরও অন্তত একশ’ হেক্টর নিচে নেমে এসেছে। সর্বোপরি রোববার রাতে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কম ছিল। ফলে দ্রুত তাপমাত্রা কমে আসে। এসব কারণ মিলিয়েই বাংলাদেশে শীতের প্রকোপ বেড়েছে। চলছে ‘অতি তীব্র’ শৈত্যপ্রবাহ। সোমবার বিকালে বিএমডির কর্মকর্তা ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, শীতের প্রকোপ উত্তরাঞ্চলে বেশি থাকলেও রাজধানীতে কম শীত ছিল না। সোমবার ঢাকায় তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে নেমে আসে। দিনেও তাপমাত্রা বাড়েনি। এর আগে ১৯৬৪ সালের ১৮ ও ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল। সেই তুলনায় অবশ্য শৈত্যপ্রবাহ ঢাকায় তীব্ররূপ ধারণ করেনি। নগরায়ণের কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।
তীব্র রশ্মিতে মাঠে ময়দানে কাজ করা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ এবং শ্রমজীবীরা বললেন, ‘এক দিন কাজে না বের হইলে পেট চালানো মুশকিল। নিজেরা খাই বা না খাই, পরিবারের ছেলেমেয়েদের দুবেলা বেলা খাবার জোগাড় করতি হবে। শীতের কষ্ট গায়ে সইলেও পেটে সয় না। কষ্ট হলেও তীব্র শীতেও দিনে রাতে কাজ করতে হয়।