অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম
এই মেয়ে দুর্গম পাহাড়ে তুমি এসেছিলে কেন? নখ কামড়ে ছলছল চোখে বলছিলো রিনা — ভালোবাসার ফুলের গন্ধ খোঁজতে,প্রেমের মজা লুটে নিতে।
— তার মানে? অসভ্যতা করতে এসেছিলে? আর কোন জায়গা পেলে না। আমি ঐ পশুটাকে নিচে ফেলে দিতে না পারলে, সে তো তোমার চরিত্র হরন করতো।
রিনা — ঝোপ জঙ্গলময় পাহাড়ি এলাকায় বহু লোক বেড়াতে আসে। আমরাও তাই এসেছিলাম।
সাদেক — আমি তোমাদের এ কি দৃশ্য দেখলাম। মেনে নিতে পারছি না ।
আজকাল ছেলে মেয়েরা কি এভাবেই উচ্ছন্নে যাচ্ছে। মান সন্মান পানিতে ধুয়ে ফেলে দিচ্ছে।
—-না ভাইয়া, ও খুব ভালো ছেলে।এখানে বহুবার এসেছি।কোন দিন ঠোট বা হাতে চুমু দিয়েও দেখেনি, কেমন উষ্ণতা প্রেমের ফুলদানীতে ঝুলে থাকে।
আজকে কি যেন কি হয়ে গেলো। রনির নিঃশ্বাসের কাছাকাছি আসতেই সে আমার শাড়ি ব্লাউজ টানতে থাকে। যতই নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করি,ততই পাগল উন্মাদের মত বেসাল হয়ে যায়।চোখ থেকে বেরিয়ে আসে যৌন পিপাসার উত্তাপ ও উন্মাদনা। নিজেকে কিছুতেই রক্ষা করতে পারছিলাম না।আপনি না এলে তো ভয়ানক বিপদে পড়ে যেতাম।
আপনি একা একা এখানে এসেছেন কেন।
— তার উত্তর পরে দেবো।আগে তোমার ভালো মানুষটাকে বাঁচাই। ঐ দেখো গাছে ঝুলে চিৎকার করে বলছে — রিনি আমাকে রাঁচাও।রিনি প্লিজ।
এরপর সাদেক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে খুব সাবধানে।একটু অসর্তকতার জন্য সেও মৃত্যু ঝুকিতে পরতে পারে। চারপাশে কেউ নেই, কাকে ডাকবে বা কেউ এগিয়ে আসারার মত পরিবেশও নেই। তারপরও এই দুর্গম পথে পর্যটকরা মৃত্যু ভয়কে হাতে নিয়ে সৃস্টির কারুকাজ দেখতে আসে অসীম সাহস বুকে নিয়ে।
এ গাছের ডাল ও গাছের শেকড় ধরে নিচের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সাদেক।
ভয়ে দুশ্চিন্তায় পাথরের মত পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে রিনা। সাদেক- রনির ভয়াবহ সংকটময় পথচলা দেখতে থাকে। ইচ্ছে করে তারও নেমে যেতে।
রনির আত্মা তো মরন পাখীর দেশে উড়ে গেছে অনেক আগেই। রনি নিচের দিকে তাকায় না, কারণ বেশ গভীরে রয়েছে পানির খাদ।সেখানে পড়ে গেলে কুমির টেনে খায় কি না এই ভয়ে কাপে হাত পা।
রনির পাশাপাশি অবস্থানে একটি গাছে দুইটা বানর ঝুলে কিচ কিচ করছে আর এ ডাল ছেড়ে ও ডালে খেলছে। একটু পর পর ভেংচি দিচ্ছে রনিকে। সাপ বিচ্চুর ভয়ও রয়েছে।পাখীরা কিচির মিচির শব্দ করে উড়াউড়ি করছে। পাহাড়ের গতর্টিতে প্রাণের অস্থিত্ব থাকলেও মানুষের আনাগোনা নেই।
(২)
বিকেল গড়িয়ে আসছে। গাঢ় আন্ধকার নেমে আসবে কিছুক্ষণ পর । এরপর কি হতে পারে কেউ জানে না।পেট চু চু করছে খিদায়। মাথায় নানা ভয় ভীতি দুশ্চিন্তা জঠ পাকাচ্ছে। ততক্ষণে সাদেক পৌছে যায় প্রায় রনির কাছাকাছি অবস্থানে। কিন্তু রনিকে উপরে ওঠিয়ে আনবে কি ভাবে। রনির শরিরও তো নিস্তেজ হয়ে আছে। সে নিজে নিজে ওঠে আসবে সে শক্তিও নেই।
সাদেক রনিকে পিঠে তুলে উপরে উঠার চেষ্টা করতে থাকে। এক পা ওঠলে আর এক পা নিচে নেমে যায়। তারপরও সাদেক হাল ছাড়ে না। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ওঠে আসে অনেক দুর। আর আট বা দশ হাত ওঠতে পারলেই উপরে চলে আসবে।
রিনির গলা শুকিয়ে আসে আল্লাহ আল্লাহ জপতে জপতে। হাত পা শির শির করে।হৃদয়ের পানি শুকিয়ে আসে। বিশ্ব জয়ের আশায় ও খুশীতে চকচক করে চোখ মুখ।
কিন্তু না সব আশায় গুড়ে বালি চিটিয়ে দিয়ে, হিমালয় বিজয়ের মহেন্দ্রক্ষণে দুই জনেই গড়িয়ে পড়ে যায় গভীর খাদে।রনির মাথাটা পড়ে একটা পাাথরের উপর, রক্তক্ষরণ হইতে থাকে। তারপরও দুই জনেই কাদা পানিতে বসে ভাবতে থাকে কি করবে।আল্লাহ কি এই মহা বিপদ থেকে উদ্ধার করবে না।
রাখে আল্লা মারে কে।এক পাহাড়ি ছেলে পাশের খাদে মাছ ধরছিলো।সে দৌড়ে এসে রনি ও সাদেকের দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে।
প্রথমেই সে মুখ দিয়ে উচ্চস্বরে ঘো ঘো শব্দ করতে থাকে।ঘো ঘো শব্দের মানে হলো আমি বিপদে পড়েছি, আমাকে উদ্ধার করতে তোমরা এগিযে আস। মহুর্তেই দা বল্লম, সড়কি হাতে কিছু লোক জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। তারা একটি সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে পাহাড়ের উপড়ে নিয়ে গেলো সাদেক ও রনিকে।
সন্ধ্যার আলো আধারে সাদেক,রনি,রিনি আন্যান্যরাসহ সবাই যার যার গন্তব্যে ফিরে যায়।
সেই দিনেই রনি ভর্তি হয় একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে।চিকিৎসা চলতে থাকে।
রনি -রিনির প্রেমের খেলা সম্পর্কে রনির ছোট বোন জানতো।সে প্রতিক্ষণের খবরা খবর রিনিকে দিতে থাকে। এই হচ্ছে,ভালো হচ্ছে, চিন্তা করো না। রিনির তো মন মানে না।ছুটে যেতে ইচ্ছে করে।কিন্তু কোন পরিচয় নিয়ে দেখতে যাবে। সে তো রনির কেউ না।ক্লাসমেটও না।রিনি বাসায় বসে চটফট করে।
ডাক্তার নিষেধ করেছে ফোনে কথা বলতে। মোবাইল ফোন রনির কাছ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
রিনির কিচ্ছু ভালো লাগে না। কি করবে, কোথায় যাবে নিজেও বুঝে না।নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়েতে থাকে।
(৩)
হ্যালো সাদেক ভাইয়া আমি খুব মানসিক যন্ত্রনায় আছি, আপনার সাথে দেখা করতে চাই।
— তা না হয় করবে।কিন্তু তোমার সেই ভালো মানুষটির খবর কি। —সব বলবো , আগে দেখা করার সিডিউল দিন।
— বেশ তো,আগামীকাল সকাল দশটায় পালকি রেস্টুরেন্টে আস।
রাত পার হয় না।কখন সুর্য ওঠবে, ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে গিয়ে দাড়াবে। সাদেকের কাছে কি ভাবে উপস্থাপন করবে মনের অনুভুতি।
ঘুরি ঘুরি বৃষ্টি পরছিলো। বাসার সবার চোখে ফাকি দিয়ে রনি বেরিয়ে পড়ে বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার ছল করে।
মুখোমুখি হয়ে দুইজনই পালন করে নীরবতা।কে কি বলবে। কোথা থেকে শুরু করবে।
সাদেক শুরু করে — কি খবর তোমার।
রিনি —বিশ্বাস করবেন কি না জানি না,তারপরও বলছি। আমাকে পারিবারিক ভাবে বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। রনি তো নিবির পর্যবেক্ষনে হাসপাতালের বেডে শায়িত। এখন আমি কি করবো বুঝে ওঠতে পারছি না।
—আগামী কালকে রনিকে দেখে আসি,তারপর চিন্তা করা যাবে।
—- ভাইয়া আমাকেও নিয়ে চলেন না।
দুইজনই দেখতে গেলেও ডাক্তারের নিষেধ উপেক্ষা করে রুগীর কাছে যেতে পারেনি।
রিনি তার বাবা মা কে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিয়ের তারিখ পেছাতে থাকে। অপেক্ষা করে রনির সুস্থ্যতার জন্য। রনি আর সুস্থ্য হয় না।ইতিমধ্যে জ্ঞান ফিরে আসে, কিন্তু কাউকে চিনতে পারে না।
রিনির বাবা নেই।মামা তার এক মাত্র গার্জেন। টাকার প্রলোভনে পড়ে ষাট বছরের বুড়ুর সাথে রিনির বিয়ের পাকা কথা দেয়।সে বুড়ুর টাকা পয়সার অভাব নেই।রয়েছে এক পাল সন্তান,নাতি, পুতি সহ আরো এক জন স্ত্রী। কি করে এমন পরিবারে রিনি বউ হয়ে যাবে।
হবু বরের মাতায় পাকা চুল।ঠোটের দুই পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানের লাল পিক। সারাদিন বসে থাকে টুপি মাতায় তজবি হাতে নামাজের জায়নামজে। নাতি পুতি ঘুর ঘুর করে বুড়ুর চারপাশে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এমন ছাত্রী ষাটর্ধ্বো বুড়ুকে কি ভাবে বিয়ে করে।
-রিনি পরে গেছে অসহ্য যন্ত্রণায়। সে চোখ মুছে আর বলে মানুষের বাড়িতে বুয়ার কাজ করে খাবো।কিন্তু এ বিয়ের পিড়িতে বসতে পারবো না।প্রয়োজন হলে জীবনে বিয়েই করবো না।
কিন্তু মামা নাচুর বান্দা, রিনির কোন কথাই শোনে না। হবু বুড়ু বর, সেও লাপাতে থাকে।রিনির সাথে দেখা করতে, কথা বলতে চায়। সে মনে করে যৌবন যেনো নেমে এসেছে বিশ বা একুশ বছরের ঘরে ।
রিনির বাহিরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। চোখে চোখে রাখে তার গতিবিধি।
রিনির অস্বাভাবিক আচরণ দেখে আত্মীয় স্বজন সিদ্ধান নেয় জোড় করে বুড়ুর সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেবে।
এ দিকে রনি সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফিরলেও মানসিক ভাবসাম্য হারিয়ে ফেলে।জাগতিক বোধ শক্তি তার মধ্যে নেই।।
বুড়ুর ছোট নাতি দৌড়ে এসে দাদাকে জিজ্ঞেস করে — দাদা তুমি নাকি বিয়ে করবে।—হা দাদা লালটুকটুকে একটা বউ আনবো।সে তোমাকে খুব আদর করবে।গান শোনাবে।
— তাই। খুব মজা হবে। আমি নতুন দাদুর কোলে ওঠে বসে থাকবো। তুমি মারবে না তো।
দরজার আড়ালে দাড়িয়ে ছিলো দাদি।একটা ঝাড়ু হাতে ছুটে আসে। বলে — কি বললে বিয়ে করবে , ঝাটা পিটা করে বুড়ু বয়সে বিয়ে করার সাধ মিটিয়ে দেবো। হাত পা ভেঙ্গে নদীতে ফেলে দিয়ে আসবো।বিয়ে করা মানে রঙের ঘরের খেলা না।
বুড়ু ভয়ে আমতা আমতা করতে থাকে। নিরপদ দুরত্বে গিয়ে বলে — আমি বিয়ে করলে তোর ক্ষতি কি। বিয়ে আমি করবোই।
বুড়ু যতই হুম হাম করুক না কেন, বউয়ের এক আড়াঙ্গি খেয়েই বিয়ের সাধ উড়ে য়ায় অচিন দেশে।
কিন্তু রিনির মামা খুব উৎপাত করতে থাকে। মেয়েটি একদম শান্তি পায় না। রিনিকে ঘরে বন্দি করে রাখে।চোখে জল ঝরানো ছাড়া রিনির কোন উপায় নাই।
একদিন মায়ের সহায়তায় মৃদু পায়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে সাদেকের সাথে দেখা করতে। সব কথা মনযোগ দিয়ে শুনে সাদেক। রিনি বলে — আমি কি করবো এখন। কোথায় যাবো। বিষ মুখে ঢেলে দেবো। কিন্তু যাট বছরের বুড়ুকে বিয়ে করতে পারবো না। এই বলে সে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে থাকে।
সাদেক প্রেমে ছ্যাগা খাওয়া মানুষ।নারী জাতিকে বিশ্বাস করে না। সিদ্ধান্ত নিয়েছে জীবনে বিয়ে করবে না।কিন্তু এই মহুর্তে সাদেকের সারা অঙ্গ শিহরনে কাঁপছে কেন। তার মন কি চায়।
হঠাৎ করে আবেগ তাড়িত হয়ে রিনির কাছে জানতে চায় — তুমি কি চাও।কেন ছুটে এসেছ আমার কাছে।
— কি চাই জানি না।তোমার হাতটা ছুঁয়ে দেখতে চাই।
বুকে রাখতে চাই মাথা।প্লিজ ফিরিয়ে দিও না।
সাদেক — পারবে শক্ত করে এই হাতটা ধরতে।
— পারবো না কেন। এই বলে হেলিয়ে দেয় রিনি তার মাথা সাদেকের বুকে।
এর পর দুজনেই হারিয়ে যায় ঠোটে ঠোট চেপে ভালোবাসার ছায়াছবির জগতে। আবেগ ঘন কন্ঠে বলতে থাকে — হারিয়ে যেতে নেই মানা।
লেখকঃ সহ সভাপতি,বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ।
০১৭১৭৭৬২৭৪৫