এরশাদ আহমেদ
বসন্ত বাতাসে দিগ-দিগন্ত একাকার-চঞ্চলা মলয়বায়ু, ঝরা পত্ররাজি মধুছন্দায় নুপুর ধ্বনি তুলেছে! মকরন্দের গন্ধে মধু-মক্ষিকারা পাগল মাতোয়ারা-আর আমি হাঁটিতেছি সেই বনপথ ধরে! জাত-বিজাতে বনফুল-বনমল্লিকাকুঞ্জ আচ্ছাদিত স্বর্গীয় উদ্যান! বসুমাতার পরিধানে আজ শতরঙা শাড়ী, বসন্ত বউরির গানে গানে সপ্তসুরের পাড়া-বসন্তসখা সেও বিরতিহীন; এবার অমৃত সঙ্গীতে মাতাল হলো চোখগেলো দল। কেবল আমি হাঁটিতেছি আর হাঁটিতেছি -আর এ ধারায় হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে চলে এলাম ফুল ফুটানো বিশালকায় পলাশ বনে। রংবেরঙের পলাশ, লোহিত রক্ত পলাশ, সোনালি স্বর্ণ পলাশ-লতানুকুসুম পুষ্প রাজি তারি শাখাতে শাখাতে দুলে আছে। অগ্রে গমণ করতে লাগলাম, তখনই কর্ণকুহরে বার্তা দিল বাউল গানের স্বর আর আমি বিলম্ব না করে ত্বরা করে সেথায় চললাম। এবং অবশেষে পৌঁছে গেলাম গেরুয়া বসনে সজ্জিত বাউলের সন্নিকটে। বাউল সঙ্গীতে উন্মাদ চারপাশ, তারে ঘিরে শাখায় শাখায় গানের বিহঙ্গরা! বিভোর হয়ে শ্রবণ করিছে অমৃত বাউল সঙ্গীত! চরণে মর্মর বাজিতে লাগলো শুষ্ক মৃত পত্ররা, সেই মর্মর ধ্বনি গিয়ে বিঁধলো বাউল কর্ণে-বাউল সম্বিত ফিরে পেয়ে চক্ষু তুলে তাকালো এবং জিজ্ঞাসিল কবি?
কবি, “বাউল, এই স্বর্গপুরীতে কখন এলে?”
বাউল, “এই তো কবি এই দ্যুলোক মঞ্জিমায় সাতদিন গত হলো মাতিয়াছি, সৃষ্টির উল্লাসে মোর মন ভরপুর! “
কবি, বাউল তুমি যে মাতিবেই, এ যে আসমানী উদ্যান সত্যিকার স্বর্গ! মৃত মন’রা কখনোই তার আনন্দ খোঁজে পায় না।
বাউল, “কবি, দৈবাৎ কি মনে করে এলে? “
কবি, একটা প্রহর কেবল স্বর্গের নিভৃতচারী হয়ে ভ্রমণে বেড়িয়েছি গো আমি বাউল। এখন ভাবছি ক’টা দিন তোমার সঙ্গ পেলে মনটা বড় উৎফুল্লে ভরে উঠবে।
বাউল, “তুমি আমার সঙ্গে যাবে কবি?”
কবি, কোথা যাবে তুমি?
বাউল, “এই পলাশ স্বর্গ পেরোলেই সামনে স্বর্গের প্রেমনদী তারি ওধারেই স্বর্গশিমুল কান্তার-পাশেই স্বর্গপাড়া! সুরসুন্দরীরা সেথায় নেচে-গেয়ে দিন কাটায়। এতদিনে শিমুল মেয়েরা কুসুমে কুসুমে লালে লাল হয়ে গেছে! মধুপায়ী বিহঙ্গরা ফুলমধু পান করিতে করিতে তৃপ্ত প্রায় চলো না কবি সেথা যায় দুটো ভাত-পয়সাও জুটবে তাহলে-তুমি তারি একধারে শিমুল বনের নিভৃতে তোমার কাব্যরচনায় মশগুল হবে আর আমি অন্যধারে বসন্ত বটতলে ঐ স্বর্গপাড়ার লোকারণ্যে সংগীত পরিবেশন করবো। আমাদের স্বর্গভোগ হবে অমিয় অমৃত! সেথা পুষ্পে পুষ্পে মধুভৃৎ গুনগুনানি-অমিয় সুরছন্দা মধুছন্দা, মদুবন জুড়ে মৌ-সুরা ভরা, এ যেন মধুপুরী মথুরা নগরী! স্বর্গপুরীর মিষ্টি জলে জল মধুদক একবার পান করিলে যা নরক জ্বালা মেটে। বাউলা বিহগরা সেথা দিবা যামিনী গায়।”
কবি, এ যে লোভনীয় আমন্ত্রণ! তোমার মুখ হতে যতই শুনেছি ততই মুগ্ধ হয়েছি! আমি যাব বৈকি।
বাউল, “তাহলে আর দেরি কেন কবি-এবেলা চলো।”
কবি, তবে তাই হোক মোদের পথচলা।
বিহঙ্গরা, “হে বাউল, কবি, তোমরা কোথা যাও আমাদের ফেলে!” সকল বিহঙ্গকুলের মনমনস্ক ভাব।
কবি, “আমরা এখন অন্যত্র যাচ্ছি হে পক্ষী সকল।
বিহঙ্গরা, ” তেমরা যেও না আমাদের ফেলে আমাদের ফেলে আমরা কবিতা শুনবো! সঙ্গীত শুনবো!”
কবি, “আমাদের তো যেতেই হবে যে হে পক্ষী সকল-এ যে চিরস্থায়ী থাকার স্থান নহে বন্ধু, আমরা তো কেবল এ স্বর্গদেশের পথিক মাত্র-আমরা যে ভ্রমণরত আমাদের বিদায় দাও হে (পক্ষীকুল) বন্ধু সকল। এখন হতে এই শূন্যের স্বর্গ বাগানে তোমরাই গাইবে! তোমরাই নাচবে! আগামী বসন্তে তোমাদের সহিত আবার-ই দেখা হবে। আবার আমরা সঙ্গীত শুনবো কাব্যশ্রবণ করবো-স্বর্গরাজ তো আমাদের এভাবেই পয়দা করেছে সকল দেশের সকল জাতের জন্যে!
একথা শুনে সকল পক্ষীকুল এবার নীরব হলো! তখন তারা কেবল আবদার করলো-তারা বললো, ” তাহলে আমাদের পালকে পালকে একটা একটা করে পঙক্তি লিখে দিয়ে যাও আবার যতদিন ফের দেখা না হবে তোমার লিখে দিয়ে যাওয়া পঙক্তিখানি গায়বো।”
কবি, “তাহলে দাও তোমাদের ডানা খানা বাড়িয়ে,” এই বলে পক্ষীকূলের প্রত্যেকের ডানার পালকে পালকে একটি একটি করে কলি লিখে দিয়ে আমরা বিদায় নিলাম। আমরা পথ চলিতে লাগলাম অগ্রপানে এভাবে চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম সেই স্বর্গ শিমুল পাড়ায় যেথায় স্বর্গনদী প্রেমে প্রবাহিত! যেথায় সহস্র প্রজাতি পুষ্পরা ফুটে ফুটে একাকার, যেথায় বসন্তঘোষ মদিরা পানে মাতাল বিহ্বল; অমৃত সুরা পানে মধুকর বিভোর যেথায় স্বর্গ সুন্দরীরা ফুলমালা গলে পড়ে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে নৃত্যরত, তারি মাথার উপরে তরুশাখা ‘পরে হলুদিয়া বিহগ গায়-দিবা মধুরাতিতে যেথা হাজারো পাখি গায়, যাদের গীত বাউলা বউ কথা কও, চোখগেলো, বসন্ত বউরি সৃষ্টিতে মাতাল।