আতাউল গণি, অষ্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ :
শিক্ষা একটি মৌলিক মানবাধিকার যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত হাওর জনপদের শিশুরা। অবারিত হাওরে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও কর্মমুখী শিক্ষার সুযোগ পাওয়া একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থা হাওরাঞ্চলে শিক্ষার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। যদিও নান্দ্যনিকতায় পূর্ণ এক বৈচিত্রময় ভূ-প্রকৃতি,পরিবেশ প্রতিবেশ ও জীব বৈচিত্রের সমীরণে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ এক লীলাভূমি। মাছ, শস্যসহ অফুরন্ত নানা প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার। তবুও যুগ যুগান্তর ধরে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অনগ্রসর হাওরবাসী। উপজেলায় 50টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, 13টি মাধ্যমিক ও 03টি উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এখানে ঝড়ে পড়ার হার অত্যধিক।
সরেজমিনে ও বিভিন্ন অংশীজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়-হাওরের শিক্ষা ব্যবস্থা নানা সংকট, সীমাবদ্ধতা ও অনিয়মে জর্জরিত। বছরের অধিকাংশ সময় বর্ষার পানিতে নিমজ্জিত থাকে হাওরাঞ্চল। তখন খাল,বিল,নদী হাওরের চরম প্রতিকূলতা ও বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে পৌছাতে হয় বিদ্যালয়ে। বৈরী আবহাওয়ায় ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা,বাঁশের সাঁকো ব্যবহার করে বিদ্যালয়ে যেতে পড়তে হয় চরম বিপাকে এমনকি ঝড় বা স্রোতের কবলে পড়ে কোন কোন সময় নৌকা ডুবে প্রাণহানির সম্ভাবনাও থাকে। উপজেলার দুর্গম হাওরের অধিকাংশ বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন চিত্র এটিই।
অভিভাবকদের উদাসীনতা হাওরাঞ্চলের শিক্ষার অন্যতম অন্তরায়। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে গেল কি-না, নিয়মিত পড়ালেখা করছে কি-না, পাঠোন্নতি সন্তোষজনক কি-না এসব বিষয়ে অধিকাংশ অভিভাবকের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। উপরন্তু নিয়ত নিদারুণ সংগ্রাম করে জীবিকা নির্বাহ করা অধিকাংশ কৃষিজীবি পরিবারের অভিভাবক কৃষি রোপন, ফসল উঠানোর মৌসুমে ছেলেমেয়েদের সহযোগি হিসেবে কাজে নিয়োজিত করে ফলে তাদের পড়া লেখায় বিঘ্ন ঘটে।
হাওরাঞ্চলে শিক্ষক সংকট মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। শহর থেকে হাওর এলাকায় গিয়ে শিক্ষাদানে অনেক শিক্ষক উৎসাহিত হয় না। ফলে বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সংকট চরম আকার ধারণ করে। শিক্ষক স্বল্পতায় পাঠদানে মারাত্বক বিঘ্ন ঘটে। বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক বেতন কাঠামো না থাকায় অনেকেই অসন্তোষ্ট। আবাসন সুবিধা না থাকায় অনেকেই 50-60 কিমি দূর থেকে আসা যাওয়ায় বাড়তি আরেকটা মানসিক ও আর্থিক চাপে থাকে ফলে পাঠদানে বিরুপ প্রভাব পড়ে।
শিক্ষকদের উদাসীনতা, নিজেদের মধ্যে দ্বন্ধ, অসন্তোষ, জবাদিহিতার অভাব হাওরে শিক্ষার একটি প্রধান অন্তরায়। হাওরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা নাই বললেই চলে। অভিভাবকগণও ফলাফল বিপর্যয় কিংবা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কোন খোজখবর রাখেন না। ফলে জবাবদিহিতার বাইরে থেকে শিক্ষকগণ নিজের ইচ্ছামাফিক যাচ্ছেতাই পাঠদান করে থাকেন। শিক্ষকদের এহেন দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতায় প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় শিক্ষার্থীরা। লক্ষণীয় কতিপয় শিক্ষক গায়ের জোড়ে বিভিন্ন প্রভাব দেখিয়ে শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করে শিক্ষকদের মাঝে গ্রুপিং সৃষ্টি করে রাখে ফলে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্বকভাবে বিঘ্নিত হয়। তাছাড়া বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির নেতৃত্ব,দূরদর্শিতা,সক্ষমতা, নৈতিকতা এখানে একটি বড় প্রশ্ন। অধিকাংশ প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির দৌড়াত্বে বিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা, অর্থনৈতিক লেনদেনে মারাত্বক অনিয়ম দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ফলে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্বকভাবে বিঘ্নিত হয়।
সর্বোপরি হাওরের ছেলে-মেয়েরা মেধায় পিছিয়ে নয়, তারা পিছিয়ে পড়ে আর্থিক দৈন্যতা, যাতায়াত ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতা, অভিভাকের অস্বচ্ছলতা-অসচেতনতা, উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ না পাওয়ার কারণে। প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরোনোর আগেই অধিকাংশ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ে। যারা মাধ্যমিক পর্যায়ে যায় তাদের অল্পসংখ্যক ভাল শিক্ষার সুযোগ পায়, যার দরুণ তাদের উচ্চ শিক্ষা লাভের ভিত থাকে দুর্বল। তাই আগামী দিনের দক্ষ,অভিযোজনে সক্ষম উত্তম নাগরিক গড়ে তুলতে হলে উর্পযুক্ত সকল বাঁধা ভেঙ্গে একটি কার্যকর শিক্ষার পরিবেশ তৈরী করে হাওরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌছে দিতে হবে শিক্ষাকে।