আমিনুল হক সাদী
তানজিনা আক্তারকে অল্প বয়সেই বসতে হয়েছিল বিয়ের পিঁড়িতে। এ কারণে বন্ধ হয়ে যায় তার পড়াশোনা। সবার মতো তারও শুরু হয় সংসার জীবনের ব্যস্ততা। তবে বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইচ্ছা মনোবল থাকলে যে অসম্ভবকে জয় করা সম্ভব তা দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। স্বজন ও প্রতিবেশীদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ উপেক্ষা করে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৪.২৯ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন চার সন্তানের জননী তানিয়া।
সম্প্রতি প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে এ তথ্য জানা গেছে।জানা গেছে সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার ফজলুল হকের কন্যা তানিয়া আক্তারের সাথে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের উত্তরপাড়া হাজী বাড়ির ইদ্রিস মিয়ার ছেলে ইসরাঈল মেহেরুন্নেসা টেকনিক্যাল স্কুলের শিক্ষক আমিরুল ইসলাম ইয়াসিনের বিয়ে হয় ২০০৯ সালে। বিয়ের পর ১৪ বছরের সংসার জীবনে এক ছেলে ও তিন মেয়ের জন্ম হয়। এর মধ্যে বড় মেয়ে ইসরাতুল জাহান কিশোরগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। দ্বিতীয় মেয়ে নুসরাত জাহান মুন শুকুর মামুদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ শ্রেনিতে ও তৃতীয় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মিম ১ম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত। ৫ বছরের ছেলের নাম আমির হামজা।
পরিবার সূত্রে জানা গেছে, জামালগঞ্জের আলাউদ্দিন মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি লেখাপড়া করা অবস্থায় অদম্য ইচ্ছেটা বুকের মধ্যে রেখে তানজিনা আক্তারকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। বিয়ের পর বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। পিঠাপিঠি ৪ ছেলে-মেয়েকে মানুষ করতেই চলে যায় ১৪ বছর। সচরাচর কোনো কারও লেখাপড়ার ইচ্ছাশক্তি আর এতো বছর বাঁচে না। কিন্তু তানজিনা আক্তার দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে জয় করা যায়। দীর্ঘ ১৪ বছরে সংসারে চারজন নতুন অতিথি এলেও তানজিনার লেখাপড়ার ইচ্ছা দমেনি।
এত কিছুর পরও তানজিনা চেষ্টা অব্যাহত রাখেন, কীভাবে নিজেকে লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনা যায়। এরই চেষ্টায় স্থানীয়ভাবে নিজেকে বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলেন। কিছুটা হলেও সংসারে আয় ফিরতে শুরু করে। নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে সুপ্ত বাসনাকে পূরণ করতে স্বামীর উৎসাহে স্বামীর শিক্ষকতায় ইসরাঈল মেহেরুন্নেসা টেকনিক্যাল স্কুলে পুনরায় ভর্তি হন নবম শ্রেণিতে। স্বামী শিক্ষক স্ত্রী ছাত্রী হিসেবে দক্ষতার সহিত চালিয়ে আসছিলেন পড়াশোনা। এবারের এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন তানজিনা ।
তার ইচ্ছা সমাজের আর দশটা মানুষের মতো তিনিও নিজেকে একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে পরিচয় দেবেন। তানজিনার আশা পূরণ হয়েছে, তবে আরও ভালো ফলাফল না করতে পেরে কিছুটা হলেও মন খারাপ। এদিকে এ ফলাফলে আত্নীয় স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী সবাই খুশি।
তানজিনা আক্তার বলেন, ছোট থেকে পড়াশোনার প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিল। বড় পরিবারে বড় হয়েছি। অস্ট্রম শ্রেণীতে পড়াকালেই বিয়ে হয়ে যায়। ফলে এসএসসি পরীক্ষার জন্য ইচ্ছা থাকলেও পরীক্ষার আগেই বিয়ে দিয়ে দেন বাবা-মা। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পড়াশোনাটা করতে পারিনি। তবে পড়াশোনার তাড়না মনে দাগ কেটেছে সব সময়।
তিনি বলেন, বিয়ের পর চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের পড়ার কথা ভাবার সময়ই হয়নি। পরে নিজের অদম্য ইচ্ছা ও স্বামী-সন্তানদের অনুপ্রেরণায় আবার পড়াশোনা শুরু করি। সমাজের আর দশটা মানুষের মতো আমিও একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে যাতে পরিচয় দিতে পারি এজন্যই কষ্ট করে পড়াশোনাটা আবার শুরু করেছি। এসএসসি পাস করে কষ্ট সার্থক হয়েছে।
তানজিনা বলেন, মানুষের প্রেমে না পড়ে বইয়ের প্রেমে পড়লে মানুষ যে সফল তার উদাহরণ আমি নিজেই।আমার ফলাফলে সবাই খুশি। এবার উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
তানজিনা আক্তারের স্বামী ইসরাঈল মেহেরুন্নেসা টেকনিক্যাল স্কুলের শিক্ষক আমিরুল ইসলাম ইয়াসিন বলেন, আমি তার ইচ্ছেটার মর্যাদা দিয়েছি। সে যতদূর পড়াশোনা করতে পারে, আমি চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করব। তার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাই। মা ও মেয়ে একসঙ্গে পাস করলে আরও ভালো লাগতো।
ইসরাঈল মেহেরুন্নেসা টেকনিক্যাল স্কুলের অধ্যক্ষ হাজী ইসরাঈল বলেন, তানজিনা একজন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মানুষের ইচ্ছাশক্তি থাকলে লেখাপড়ায় বয়স কোনো বাধা নয় তিনি সেটা প্রমাণ করেছেন। তানজিনা আক্তারের এমন উদ্যোগ অনেককে অনুপ্রাণিত করবে। আমরা তার সাফল্য কামনা করি।
সম্পাদক ও প্রকাশক- খায়রুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক - সোহেল রানা
সম্পাদকীয় কার্যালয়- ৫২২ আইনুল্লাহ স্কুল রোড, স্বল্পমারিয়া, বএিশ, কিশোরগঞ্জ।
০১৯১২৫৫০৭২৭,০১৭২৪৫৭৪২১৭
Copyright © 2025 কালের নতুন সংবাদ. All rights reserved.