রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫, ১১:৫৩ অপরাহ্ন
পর্যালোচনায় ৫৪ তম বাজেট
-
প্রকাশ কাল
রবিবার, ২৯ জুন, ২০২৫
-
৭
বার পড়েছে
রেহানা ফেরদৌসী:
গত ২রা জুন ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের জন্য ৫৪ তম বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। সার্বিক পর্যালোচনায় বাজেটে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার একটি কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনীতির আকার বিশ্লেষণে উন্নয়ন বাজেটের পরিমাণ সীমিত আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর প্রবণতা লক্ষণীয়। রড সিমেন্টের দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনার দেখা দিয়েছে। ফ্লাট ও জমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে খরচ কমানোর প্রবণতা দৃশ্যমান। মোবাইল বিলের ওপর নতুন করে কোন কর ধার্য করা না হলেও মোবাইল ফোন সেটের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। সর্বোপরি অর্থনীতিকে তার নিজস্ব গতিশীলতায় আনয়নের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়েছে।
বাজেট ২০২৫-২৬ এর পর্যালোচনা ঃ
২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পরে এটিই প্রথম বাজেট। বাজেটকে ঘিরে জনগণের পক্ষ থেকে যে প্রত্যাশা ছিলো, ঘোষণার পর দেখা গেল, এই বাজেট যেনো পুরনো বাজেটেরই ধারাবাহিকতা। ফলে তা জনপ্রত্যাশাকে পূরণ করতে পারেনি।
প্রথমেই আমরা দেখবো সরকারের কর-প্রস্তাবের অর্থাৎ, বাজেটের আয়ের দিকগুলো। কেননা বাজেট সাম্প্রতিক অতীতের তুলনায় যতোই বড় বা ছোট করা হোক এর বাস্তবায়নযোগ্যতা নির্ভর করছে সরকার ওই বাজেট অর্থায়ন করার যে প্রক্রিয়া প্রস্তাব করা হয়েছে। তা কতোটুকু বাস্তবসম্মত- তার ওপর।
- কর প্রস্তাব ঃ
প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের মাঝে এসে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করে সরকার।
রাজস্ব আয়ের নতুন লক্ষ্যমাত্রাটি বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ৮.৯ শতাংশ বেশি। রপ্তানি বহাল রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১১০ পণ্য আমদানিতে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমবে। ফলে ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের সিংহভাগকেই আগের মাত্রায় কর দিতে বেগ পেতে হবে। এ অবস্থায় ৮-৯ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জিং হবে।
আসছে বছরেও রাজস্ব আয়ের জন্য সরকার পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা কমাতে পারেনি। পরোক্ষ কর ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকল আয় শ্রেণীর নাগরিকদের ওপর বর্তায়। তাই রাজস্বের জন্য পরোক্ষ করা তথা ভ্যাটের ওপর নির্ভরতা যতো কমানো যায় কর প্রস্তাব ততোই জনবান্ধব হয়। চলতি অর্থবছর-সহ সাম্প্রতিক পঁাচটি অর্থবছরে এনবিআর মোট যে রাজস্ব আহরণ করেছে তার ৩৯ শতাংশই এসেছে পরোক্ষ কর বা ভ্যাট থেকে। দেখা গেছে এনবিআর-এর রাজস্বের সবচেয়ে বড় উৎসই এই ভ্যাট। আসন্ন অর্থবছরে এনবিআর-এর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৪ লক্ষ ৯৯ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৮৮ হাজার কোটি টাকার বেশি আদায় করা হবে ভ্যাট থেকে, যা এনবিআরের মোট লক্ষ্য মাত্রার ৩৮ শতাংশ। ফলে রাজস্বের জন্য সরকার সকলের ওপর করের বোঝা চাপানোর পথেই এগোচ্ছেন।
মূল্যস্ফীতির লাগামহীনতা থেকে মধ্যবিত্তদের রেহাই দিতে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়ানোর প্রত্যাশা থাকার পরও নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবে করমুক্ত আয়ের সীমা আগেরটিই বহাল রাখা হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে বেসরকারি চাকরিজীবীদের করযোগ্য আয় পরিগণনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বাদযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ সাড়ে ৪ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করায়- বেসরকারি চাকরিজীবীরা কিছুটা স্বস্তি পাবেন। বাদযোগ্য অঙ্কের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকা তথা ১১ শতাংশের সামান্য বেশি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এ সময়ে মূল্যস্ফীতিও প্রায় দুই অঙ্ক ছুঁই ছুঁই অবস্থায় রয়েছে। কাজেই মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় নিলে বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বাজেটের প্রস্তাবিত কর-সুবিধাটি নিতান্ত নগণ্যই বলতে হয়।
আসছে অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা অপরিবর্তিত রাখলেও অর্থ মন্ত্রণালয় পরের অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা আরও ২৫ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কিন্তু ওই অর্থবছরে সবচেয়ে নিচের ট্যাক্স স্ল্যাবের করদাতাদের ওপর প্রযোজ্য করহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার কথাও বলা আছে। তাই যদি হয়, তাতে করমুক্ত আয়সীমা বাড়লেও যারা করের আওতায় পড়বেন তাদের মধ্যে তুলনামূলক কম আয় কারি ব্যক্তিদের ওপর করের বোঝা এখনকার তুলনায় বাড়বে। অথচ যারা ধনী তাদের ওপর করের বোঝা কমবে। অর্থাৎ আয়কর থেকে আসা রাজস্ব বৃদ্ধির পুরো চাপটা পড়বে মধ্যবিত্তের ওপর। বাজেটে কর ফঁাকি প্রতিরোধের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। নেই ধনীদের কাছ থেকে অধিক কর আদায় করে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ও শিক্ষা স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ উন্নয়নে ব্যয় করার নীতি। ফলে তা ধনী গরিবের ব্যবধান বা আয় বৈষম্য কমিয়ে একটি ভারসাম্যমূলক অর্থনীতি প্রণয়নে উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না।
- খাতওয়ারি বরাদ্দের বিশ্লেষণ ঃ
অন্তর্বর্তী সরকার বেশ আগে থেকেই বাজেটের আকার ছোট করার কথা বলে আসছিলো। মোট জাতীয় বাজেটের আকার এবারের প্রস্তাবনায় কিছুটা সত্যিই কমানো হয়েছে। আমরা একে স্বাগত জানাই। তবে এর প্রভাব শিক্ষা ও স্বাস্থ্যর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ খাতের ওপর পড়েছে, যা একেবারেই কাম্য ছিলো না।
- বাজেটে শিক্ষা ঃ
এবারো শিক্ষার মোট বরাদ্দ জিডিপির ১.৭ ভাগের আশেপাশেই রয়েছে আগের মত। অথচ বাংলাদেশের মতো দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ এখানে জনশক্তি তৈরির খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ। তবে বরাদ্দের মোট পরিমাণের মতোই কিংবা আরো গুরুত্বপূর্ণ হল বরাদ্দের খাত। আগেও শিক্ষায় সরাসরি বরাদ্দের সঙ্গে অন্যান্য বরাদ্দ যুক্ত করে এ খাতের বরাদ্দ বেশি দেখানোর প্রবণতা ছিলো। এবারেও তা বহাল আছে। তবে শিক্ষায় প্রকৃত অর্থে যে বরাদ্দ দেয়া হয় তা যায় মূলত তিনটি মন্ত্রণালয়/বিভাগে।
এগুলো হলো- ০১) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, ০২) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, এবং ০৩) কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ।
আগের বছরগুলোতে দেখা গেছে যে, এই তিন মন্ত্রণালয়/বিভাগের জন্য মোট বরাদ্দ অর্থাৎ প্রকৃত অর্থেই শিক্ষার জন্য যে বরাদ্দ তার বড় অংশ (৭০ থেকে ৭২ শতাংশ) যায় এই মন্ত্রণালয়/বিভাগগুলোর সংশ্লিষ্ট সচিবালয়ে এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সরাসরি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যায় মাত্র ২৬ থেকে ২৯ শতাংশ। আর অবশিষ্ট ১-২ শতাংশ অন্যান্য কাজে ব্যয়িত হয়। সরাসরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট শিক্ষা বরাদ্দের এক-চতুর্থাংশের মতো যাওয়ার অর্থ হলো মোট যা বরাদ্দ দেয়া হয় তার চার ভাগের মাত্র এক ভাগের সরাসরি সুফল ভোগ করছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। বাদবাকি বরাদ্দের বড় অংশই কেন্দ্রীয় পর্যায়ের ব্যবস্থাপনা ব্যয় (পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়)।
কেন্দ্রীয় পর্যায়ের কার্যালয়গুলোতে বরাদ্দের যে বিশাল অংশটুকু যাচ্ছে তা দিয়ে অফিস চালানো, শিক্ষার মানোন্নয়ন, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির পাশাপাশি উন্নয়ন ব্যয়ও নির্বাহ হয়ে থাকে। তবে সেখানেও অপচয় বা ভুল বরাদ্দের সংস্কৃতি দেখা গেছে। গড়ে মোট মূলধন ব্যয়ের ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ যাচ্ছে নতুন ভবন আর অবকাঠামো নির্মাণে। ফলে শিক্ষার মানোন্নয়ন কিংবা গুণগত পরিবর্তনের উদ্যোগের জন্য বরাদ্দ অবশিষ্ট থাকছে সামান্যই।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতনাদি সরকার বহন করে সেখানে কর্মচারীদের ব্যয় যুক্ত করা প্রয়োজনীয় হলেও সেক্ষেত্রে নতুন বরাদ্দ দেখা যায় নি।
সমস্ত বিদ্যালয়ে ভালো মানের লাইব্রেরী ও ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা করা যেতে পারত যা ভবিষ্যৎ সরকার গুলোর জন্য একটি উদাহরণ হয়ে থাকতে পারত। শিক্ষা উপকরণ ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বহু বছর থেকে চলে আসে একটি সংকটের সমাধানের দিকে এগোতে পারতো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর কোনটিই আমরা দেখতে পাইনি।
- স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ঃ
নতুন বছরের বাজেট প্রণয়নে সম্ভবত স্বাস্থ্য খাতেই সবচেয়ে বেশি গতানুগতিকতার আশ্রয় নিয়েছে। চলতি বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ৪১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কিছু বেশি বরাদ্দ করা হয়েছিলো। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও প্রায় সমান পরিমাণ (৪১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার কিছু বেশি) বরাদ্দ করেছে।
স্বাস্থ্যের উপখাতওয়ারি বণ্টনের ক্ষেত্রেও এই গতানুগতিকতা আমরা দেখছি। আগে মোট বরাদ্দের যে অংশ বিভিন্ন উপখাতে গিয়েছে এবারও তাই প্রস্তাব করা হয়েছে। বহু বছর ধরেই স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য জনচাপ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু বরাদ্দের এই গদবাধা কৌশল দেখে বেরিয়ে আসার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে প্রায়শ সরকার পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়টির বাজেট বাড়ানোর দক্ষতা কম হওয়ায় এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো যাচ্ছে না। এ কথায় কিছুটা সত্যতা আছে। চলতি বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে (যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে) স্বাস্থ্য খাতের জন্য ৪১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার কিছু বেশি বরাদ্দ করা হলেও সংশোধিত বাজেটে এই পরিমাণ ২৭ হাজার ৯০০ কোটি টাকার কিছু বেশিতে নেমে এসেছে (অর্থাৎ প্রস্তাবিতর চেয়ে সংশোধিত স্বাস্থ্য বাজেট এক-তৃতীয়াংশ কম)। যা পূর্বেও ছিলো। বাজেট বাস্তবায়নের অদক্ষতা বহাল থাকার প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়ানোর যেমন উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিলো।
স্বাস্থ্য খাতের সকল উপখাতের বাজেট বাস্তবায়ন কম নয়। ’মেডিকেল ও সার্জিক্যাল সাপ্লাই’ উপখাতের বরাদ্দ থেকে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে ঔষধ ও বিভিন্ন চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ করা হয়। স্বভাবতই বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে এই সেবার বিপুল চাহিদা রয়েছে। তাই এই উপখাতের বরাদ্দ অব্যয়িত থাকে না। বরং প্রাথমিকভাবে যা বরাদ্দ দেয়া হয় তার চেয়ে পরে গিয়ে বেশি ব্যয় করতে হয়। চলতি অর্থবছরেই প্রস্তাবিত বাজেটে ‘মেডিকেল ও সার্জিক্যাল সাপ্লাই’ উপখাতে প্রায় ৪ হাজার ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংশোধিত বাজেটে এই বরাদ্দ আরও ১৪ শতাংশ বাড়িয়ে প্রায় ৪ হাজার ৬ শত কোটি টাকা করা হয়েছে।
বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে ঔষধ-সহ চিকিৎসা সামগ্রী বাবদ বরাদ্দ বাড়ানো গেলে তা অব্যয়িত থাকে না এবং স্বাস্থ্য বরাদ্দ প্রকৃত পক্ষেই সাধারণ মানুষের কাজে আসে। স্বাস্থ্য খাতের দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার অল্প সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কঠিন হলেও, এই স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপটি এবারের বাজেটে রাখা হলে ভালো হতো। আমাদের দেশে মোট যা স্বাস্থ্য ব্যয় হয় তার ৬৭-৬৮ শতাংশই বহণ করতে হয় নাগরিকদের নিজেদের, আর সরকারের বাজেট থেকে আসে মাত্র ২৩ শতাংশ। আর নাগরিকরা যে ৬৭-৬৮ শতাংশ স্বাস্থ্য ব্যয় বহন করেন তার দুই-তৃতীয়াংশই চলে যায় ঔষধ আর চিকিৎসা সামগ্রী বাবদ। কাজেই সরকার ‘মেডিকেল ও সার্জিক্যাল সাপ্লাই’ বাবদ বরাদ্দ বাড়ালে নাগরিকদের ওপর স্বাস্থ্য ব্যয়ের চাপ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমানো সম্ভব হতো আগামী অর্থবছরেই।
- কৃষি খাতে বরাদ্দ ঃ
বাজেটে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্যনিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়েছে, যার পরিমাণ ১ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার ছোট হলেও কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি (বিশেষত খাদ্য মূল্যস্ফীতি), খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অনিশ্চিয়তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা, কৃষকের জন্য ঋণ প্রবাহ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে যদি বিবেচনায় নেয়া হয় তখন বোঝা যাবে বরাদ্দের এই বৃদ্ধির খুব বেশি সুফল দেবার সম্ভাবনা নেই।
কৃষি খাতের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি ও সুরক্ষার জন্য সরকারের ব্যক্তিখাত-নির্ভরতায় কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রদান করে একটি নতুন প্রজ্ঞাপন জারির প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। এতে বোঝা যাচ্ছে কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সরকার ব্যক্তি খাতের ওপরই নির্ভর করতে চাইছে। সরকারের নিজের উদ্যোগ নেয়ার সম্ভাবনা এখানে কম। একইভাবে স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন উৎসাহিত করতে কম্বাইন হারভেস্টার তৈরির যন্ত্রাংশ আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব করা হয়েছে।কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ক্ষেত্রে যে কর ছাড়গুলো দেয়া হয় সেগুলোর সুফল কৃষকরা যতোটা না পান তার চেয়ে বেশিটুকু পকেটস্থ করে যন্ত্র/যন্ত্রাংশ আমদানিকারকেরাই।
- সামাজিক সুরক্ষার বাজেট ঃ
সামাজিক নিরাপত্তা খাতের “ব্যাপ্তি এবং গুরুত্ব” বিবেচনায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে পেনশন ব্যতীত সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ দঁাড়াবে ৯১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারিদের প্রাপ্য পেনশনকে সামাজিক সুরক্ষার বাজেটে ঢুকিয়ে দিয়ে এ বাবদ বরাদ্দ বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতাটি অগ্রহণীয়।
অনেকগুলো সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় যে ভাতা দেয়া হয় তার পরিমাণ ১০০-২০০ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। প্রাপ্য ভাতার পরিমাণ বাড়ানোকে স্বাগত জানাতেই হয়। তবে সেই সাথে এটাও মনে করিয়ে দিতে চাই যে, এতো সামান্য বৃদ্ধিতে এই দুর্মূল্যের বাজারে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের ওপর খুব বেশি ইতিবাচক প্রভাব আশা করা যাবে না। এছাড়াও বাজেট বক্তৃতায় টিসিবি-র মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ করার কথা বলা হলেও ওই কার্যক্রমটি পুরো বছর জুড়ে চলবে কি-না তা বলা হয়নি। চলতি অর্থবছরেও এই কার্যক্রম থেমে থেমে বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন এলাকায় অনিয়মিতভাবে চলেছে, যা ছিলো চাহিদার তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল।
বিভিন্ন ভাতা কার্যক্রমের উপকারভোগীর সংখ্যা বাজেট প্রস্তাবে বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধি একেবারেই যথেষ্ট নয়। কারণ সাম্প্রতিক সামষ্টিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতায় বিপুল সংখ্যক মানুষ নতুন করে দারিদ্রে্য পতিত হয়েছেন। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব বলছে সর্বশেষ দশ মাসে ২৭ লক্ষ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। এদেরকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ কিন্তু বাজেটে দেখা যাচ্ছে না।
প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকে টাকা জমা রাখা সাধারণ সঞ্চয়কারীদের জন্য সুখবর রয়েছে। এবার তিন লাখ টাকার নিচে ব্যাংকে জমা থাকলে কোনো আবগারি শুল্ক দিতে হবে না। অর্থাৎ, তিন লাখ টাকা পেরোলেই কেবল এই শুল্ক প্রযোজ্য হবে।
- কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল ঃ
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন করার সময় ‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগ’ পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। এর আগে প্রস্তাবিত বাজেটে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট কেনা এবং ভবন নির্মাণে অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা চাকরিরতদের জন্য ন্যূনতম ১ হাজার ৫০০ টাকা ও পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫০ টাকা করা হয়েছে।
নিট পেনশন ১৭ হাজার ৩৮৮ টাকার ঊর্ধ্বে পাওয়ার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ ও এর নিম্নের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, বিচারপতি ও এমপিওভুক্তদের ক্ষেত্রে পৃথক আদেশ করার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।
এ ছাড়া স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরবর্তী সময়ে রপ্তানি নির্ভর প্রণোদনা ধীরে ধীরে প্রত্যাহারের তৃতীয় ধাপ হিসেবে হ্রাসের কার্যক্রম আগামী ১ জুলাই, ২০২৫ এর পরিবর্তে ১ জানুয়ারি, ২০২৬ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়তি কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে বিভিন্ন পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেই বিধান বাতিল করা হয়েছে। ফলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আর থাকছে না।
এবং এভাবেই বিভিন্ন খাতে অর্থনৈতিক বরাদ্দের মাধ্যমে রোববার সকালে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করে উপদেষ্টা পরিষদ। এবং এ বাজেট রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ আকারে আগামী এক জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। গত ২ জুন রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভিসহ অন্যান্য বেসরকারি গণমাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয় প্রস্তাবিত নতুন বাজেট।
এবার সংসদ না থাকায় সংসদের আলোচনা বা বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই। তবে বাজেট ঘোষণার পর প্রস্তাবিত বাজেটে শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গত ১৯ জুন পর্যন্ত নাগরিকদের কাছ থেকে মতামত গ্রহণ করা হয়।
রেহানা ফেরদৌসী
সহ সম্পাদক, সমাজকল্যাণ বিভাগ,
পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি
(কেন্দ্রীয় পুনাক)
মোহাম্মদ পুর,ঢাকা।
০১৯১১৫০৪৬৩৮
শেয়ার করুন
অন্যান্য সংবাদসমূহ
প্রযুক্তি সহায়তায় BTMAXHOST