"বেগম রোকেয়ার প্রতিচ্ছবি"
"বেগম রোকেয়া" নামে খ্যাত সর্বজন শ্রদ্ধেয় মোছাঃ নুরজাহান বেগম, প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক (অবঃ), হাজী গোলাম হোসেন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এবং উপজেলা পরিষদের তিনবারের মহিলা প্রতিনিদি।
অদম্য পরিশ্রম, অধ্যবসায়, সততা, সাহসিকতা এবং অনমনীয় শক্তির উপর ভিত্তি করে যারা সফল হয়েছে, সেই সাথে অনগ্রসর মানুষের মুক্তির জন্য যারা নিজের আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে শেষ পর্যন্ত সবাইকে নিয়ে জয়ী হয়েছে - ইতিহাস তাঁদের বিশেষ স্থান দিয়েছে। তেমনি একজন শিক্ষাব্রতী মহিয়সী নারী, তাড়াইলের নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবক্তা মোছাঃ নুরজাহান বেগম। জন্ম: ১৯৫২ সালের ২৫শে মে, তাড়াইল মহাজন বাড়ী। পিতা:মৃত মিঞা হোসেন মহাজন, মাতা: মৃত হাজেরা খাতুন, স্বামী: মোঃ নূরউদ্দিন ভূঞা (কারংকা ঠাকুর বাড়ি)। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হওয়ার পরেও সমস্ত প্রতিকূলতা প্রতিরোধ্যতাকে ভেদ করে, নিজে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেন। সেই সাথে তাড়াইলের শত সহশ্র মেয়েদের শিক্ষার পথ প্রসারিত করেছেন। পিছিয়ে পড়া মেয়েদের তোলে এনেছেন আলোর দিকে।
মা হাজেরা খাতুনের কাছে বাল্যশিক্ষা পড়ার মধ্যদিয়ে শিক্ষা জীবন শুরু হয়। কিন্তু মা-বাবা তেমন শিক্ষিত না থাকায় নুরজাহানে ম্যাডামের পড়াশোনার দায়িত্ব নেন ছোট চাচা আকতার হোসেন মহাজন ও ছোট চাচী আছেফা খানম। মূলত ছোট চাচীই তার প্রথম গৃহ শিক্ষক। প্রাইমারি পাশ করার পর তাড়াইলে মেয়েদের পড়াশুনার কোন ব্যবস্থা না থাকায়, তিনি ময়মনসিংহ "মুসলিম গার্লস স্কুলে" ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরে ১৯৬৩ সালে তাড়াইল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে মেয়েদের মর্নিং সিফট চালু হলে, তিনি ময়মনসিংহ থেকে তাড়াইল এসে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু দুই বছরের মধ্যে মর্নিং শিফট বন্ধ হয়ে পড়লে উনার পড়াশোনাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু পাড়াশুনা ছাড়া ম্যাডামের কিছুতেই মন বসছিল না। তাই তিনি তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আঃ রহমান স্যারের কাছে তাড়াইল পাইলট স্কুলে ভর্তির জন্য আবেদন করলে, স্যার অনেকের সাথে আলোচনা করে মেয়েদের ভর্তির ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৫ সালে তিনিই প্রথম ছাত্রী, তাড়াইল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। সাথে আরো তিন সহপাঠি ছিলেন। এরপর থেকে অধ্যবদি পর্যন্ত মেয়েদের ভর্তি কার্যক্রম অব্যাহত আছে এই স্কুলে। তিনি ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৭৩ সালে বি.এ, দ্বিতীয় বিভাগে উর্ত্তীণ হন গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে। এর মধ্যদিয়ে নুরজাহান ম্যাডাম তাড়াইল উপজেলায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম বি.এ পাশ করার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালে বি.এড এবং পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে এম.এড পাশ করেন ময়মনসিংহ ট্রিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে।
বি.এড পাশ করার পর সময় কাটতো গল্পের বই পড়ে এবং সুতার কারুকাজে মনীষীদের বাণী লিখে। সেই সময় বেগম রোকেয়ার 'মতিচুর' গ্রন্তটি উনাকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত এবং অনুপ্রাণিত করে। গ্রন্থটির মূল বিষয় হচ্ছে " শিক্ষার অভাবই নারী পশ্চাতপদতার অন্যতম কারণ। নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সম-অধিকারের মুক্তি কেবল নারীশিক্ষা প্রসারের মাধ্যমেই সম্ভব।" এই চিন্তা-চেতনা থেকে উনি নারী সমাজের মুক্তি এবং নারীশিক্ষার প্রসারের কাজে ব্রতী হন। তার ইচ্ছাকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য ১৯৮১ সালে উনার বড় চাচা নিজ নামে "হাজী গোলাম হোসেন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়" স্থাপন করার উদ্যেগ নেন এবং সেখানে নুরজাহান বেগমকে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেন।
ছোট একটি টিনের ছেলা ঘর, ১২ জন ছাত্রী, ১টি টেবিল, ৪টি চেয়ার ও ৬টি ব্যাঞ্চ নিয়ে যাত্রা শুরু করার কিছুদিনের মধ্যে কোর্টবিল্ডিং নির্মাণ করার জন্য সরকার স্কুলের জায়গাটি একুয়ার করে নিয়ে যায়। তখন উনার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিনত হয়। কিন্তু বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন যার মধ্যে আঁকড়ে আছে তাকে কী আর এত সহজে ধমানো যায়। ঠিকাদার জামান সাহেব যখন কোর্টবিল্ডিং নির্মাণ করার জন্য ট্রাকভর্তি ইট বালু নিয়ে আসে তখন নূরজাহান ম্যাডাম ট্রাক থেকে ইট নামাতে নিষেধ করে এবং টানা ১২ দিন সহকর্মীদের নিয়ে নাওয়া,খাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে ওই জায়গায় অবস্থান করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। তারপর ঠিকাদার তৎকালীন ডিসি মান্নান স্যারের কাছে অভিযোগ করলে, ডিসি সরেজমিনে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এডিসি সাত্তার স্যারকে নির্দেশ দেন। এডিসি তাড়াইল এসে টিএনও সুলতান আলমকে সাথে নিয়ে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে গার্লস স্কুল করার জন্য নতুন জায়গা একুয়ার করে।
সময়টা ১৯৮৩ সাল। বর্তমান জায়গার উপর স্কুলটিকে পুনঃগঠন করার জন্য ম্যাডাম নতুন সংগ্রাম শুরু করেন। নিজের জমানো অর্থ, স্বামীর কাছ থেকে ধার, বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চাঁদা, অনুদান সংগ্রহ করে ঘর তৈরি করেন। বাড়ি বাড়ি যেয়ে ছাত্রী সংগ্রহ করতে গিয়ে উনাকে অনেক সময় কটূক্তিও শুনতে হয়েছে। স্কুলের স্বীকৃতি পেতে দিনের পর দিন তাড়াইল- ঢাকা- ময়মনসিংহ দৌড়ঝাপ করেছেন। এভাবেই অদম্য পরিশ্রম করে শরীরের রং-কে বিবর্ণ করে তিলে তিলে গড়ে তুলেন আজকের এই বহুতল বিশিষ্ট হাজী গোলাম হোসেন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়টি। এখানে পিছিয়ে পড়া অসংখ্য গরীব অসহায় মেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। ৩১ বছর চাকুরী করে ২০১২ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
নারীদের রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন এবং মর্যাদার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৩ সালে তিনিই প্রথম তাড়াইল উপজেলা পরিষদের মহিলা প্রতিনিদি নির্বাচিত হন। এভাবে পরপর তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন। সেইসময় সমাজসেবা অফিসার, উপজেলা আইনশৃঙ্খলা সমন্বয় মিটিং-এ নুরজাহান বেগমকে " বেগম রোকেয়া " উপাধিতে ভূষিত করেন এবং উপস্থিত সবাই করতালির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানায়। সেই থেকে তিনি তাড়াইলের বেগম রোকেয়া নামে পরিচিত।
শুধু তাই নয়, তৎকালীন সময় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কোন মহিলা সংরক্ষিত আসন না থাকায় ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে উনার শশুর বাড়ি রাউতি ইউনিয়ন পরিষদে পরপর দুইবার সরাসরি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে প্রতিদন্ধীতা করেন। রাজনৈতিক অঙ্গনেও ছিল উনার অবাধ বিচরণ। ২৩ বছরের অধিক সময়কাল যাবৎ তাড়াইল উপজেলা বিএনপির মহিলা সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে সাংসারিক জীবনে স্বামী, তিন ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সুখে আছেন। মাঝেমধ্যে ছাত্রীরা ম্যাডামকে দেখতে আসে এবং কেহ আসে দোয়া নিতে। তখন তিনি আবেগ- আপ্লুত হয়ে পড়েন, অতীত ইতিহাস বলতে শুরু করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গীতাঞ্জলি কাব্যে বলেছেন "আমার এ ধুপ না পোড়ালে, গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে। আমার এ দ্বীপ না জ্বালালে, আলো নাহি জ্বলে। " ঠিক তেমনিভাবে মোছাঃ নুরজাহান বেগম নিজেকে পোড়িয়ে তাড়াইলে নারী জাগরণের আলোর বাতিঘর হয়ে আছেন। তাড়াইল-এ নারী মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে, নারী সমাজের অগ্রগতিতে উনার অবদান চির স্বরণীয়, চির অম্লান। সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও যাতে পাইলট স্কুলে পড়ার সুযোগ পায় তার জন্য সংগ্রাম করে সফল হয়েছেন। পরবর্তীতে নিজে একটি সতন্ত্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে মেয়েদের শিক্ষার পথকে স্থায়ীভাবে সুগম করেছেন। খারা পাহাড়ে উঠা কিযে পরিশ্রম, কত-যে দম লাগে তা নিজ কর্মসাধনের মাধ্যমে অন্যদের শিখিয়েছেন। বেগম রোকেয়ার মতই তিনি একজন যোগ্য শিক্ষক, প্রজ্ঞাবান সমাজ সংস্কারক, নারীর রাজনৈতিক সম-অধিকারের প্রবক্তা। তিনি মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথ প্রদর্শক। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তিনি এখনো আপোষহীন। মোছাঃ নুরজাহান বেগম শুধু একটি পরিবারের রত্নাগর্ভাই নন তাড়াইলের নারীদের কাছে বেগম রোকেয়ার প্রতিচ্ছবি।
লেখক - সম্রাট জহিরুল ইসলাম জীবন, প্রভাষক ও ইউনিট লিডার। করিমগঞ্জ সরকারি কলেজ।
সম্পাদক ও প্রকাশক- খায়রুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক - সোহেল রানা
সম্পাদকীয় কার্যালয়- ৫২২ আইনুল্লাহ স্কুল রোড, স্বল্পমারিয়া, বএিশ, কিশোরগঞ্জ।
০১৯১২৫৫০৭২৭,০১৭২৪৫৭৪২১৭
Copyright © 2025 কালের নতুন সংবাদ. All rights reserved.