তাড়াইল (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি:
কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতার বিরুদ্ধে ইউনিয়ন পরিষদকে গোডাউন ও দোকান বানিয়ে বিসিআইসি সারের ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
জানাযায় তাড়াইল উপজেলার দামিহা ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার আবদুস সালামের নিজস্ব অথবা ভাড়া করা কোনো গুদাম-দোকান নেই। তিনি সাবেক দামিহা ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনকে নিজের গুদাম-দোকান হিসেবে ব্যবহার করছেন ২০১০ সাল থেকে। যা সার ও বীজ আইন ২০০৯ এর সমন্বিত নীতিমালা ৩.২ ধারার পরিপন্থি। সাব ডিলার ও কৃষকদের অভিযোগ, আবদুস সালাম নিজের লাইসেন্সের বরাদ্দকৃত সার নির্ধারিত জায়গায় না এনে অন্যত্র বিক্রি করে দেয়, ভুয়া কৃষকদের নাম ব্যবহার করে নিজেই স্বাক্ষর-টিপসই দিয়ে রেজিস্ট্রার খাতা তৈরি করে রাখে ।
আবদুস সালাম দামিহা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পরিচয়ে বিগত ১৫ বছর ধরে রমরমা ব্যবসার নামে কৃষকদের সাথে প্রতারণা করে আসছেন। উপজেলা কৃষি অফিসকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে সরকারি নিয়ম-নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুগুলি দেখালেও রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না ডিলার আবদুস সালামের বিরুদ্ধে।
ইতিপূর্বে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাগণ ডিলার আবদুস সালামকে বহুবার সতর্ক করেছেন। কিন্তু তার বড় ভাইয়ের দলীয় ক্ষমতার কাছে তারা ছিলেন অসহায়। আবদুস সালাম আবার কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার টিসিবি’র ডিলার। তার বড় ভাই আবদুল হেকিম ইটনা উপজেলার চৌগাংগা ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার ও টিসিবি ডিলার আবার কিশোরগঞ্জ সদরের ওএমএস ডিলার। এদিকে আবদুস সালামের ভাতিজা সাইফুল ইসলাম অপুর নামে রয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলা সদর উপজেলার মহিনন্দন ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলারী।
তাড়াইল উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলার দামিহা ইউনিয়নে ৪ হাজার ৭৭৩ জন কৃষক পরিবারের জন্য একজন বিসিআইসি সার ডিলার রয়েছে। অন্যদিকে তার অধীনে খুচরা সাব ডিলারের সংখ্যা ৯ জন। দামিহা ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার মেসার্স সালাম ট্রেডার্স, প্রোপাইটার মো. আবদুস সালাম, পরিচালনায় বড় ভাই আবদুল হেকিম। মূল ডিলার সহ সাব ডিলারদের দোকানে সার বিক্রির নেই কোনো মূল্য তালিকা। সাব ডিলারদের অভিযোগ, কৃষি উপসহকারীগণ তাদের খাতাপত্র দেখেন না এবং কোনো তদারকিও করেন না।
দামিহা ১নং ওয়ার্ডের সাব ডিলার রাসেল ট্রেডার্সের দোকানের ম্যানেজার সাখাওয়াত বলেন, আমি জুলাই, আগস্ট মাসে ২ বস্তা সার নিয়েছি। সেপ্টেম্বর মাসে কোনো সার নেইনি। আপনার নামে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ইউরিয়া ৪০ বস্তা সার তুলা হয়েছে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন, এই সময়টাতে আমাদের এলাকার ফসলি জমিতে বর্ষার পানিতে থৈ থৈ করে। এসময় অত্র এলাকার কৃষকদের সারের কোনো প্রয়োজন হয়না। আমি দুই মাসে ২ বস্তা সার ছাড়া আর কোনো সার তুলিনি। দামিহা ৪নং ওয়ার্ডের সাব ডিলার মামুনের দোকানে গেলে তিনি বলেন, আমি আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ২৫ বস্তা ইউরিয়া সার তুলেছি। আপনার নামে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ইউরিয়া ৪৫ বস্তা সার ডিলারের খাতায় লিখা আছে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন, আমি ভাউচার ছাড়া কোনো সার ক্রয় করিনি। ডিলার যদি ৪৫ বস্তা ইউরিয়া সার লিখে রাখে তাহলে সম্পূর্ণ মিথ্যা লিখছে। দামিহা ৫নং ওয়ার্ডের সাব ডিলার আলী আকবর ট্রেডার্সের দোকান পরিচালক রিটু বলেন, আমি আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ১৮ বস্তা ইউরিয়া সার তুলেছি। আপনার নামে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ইউরিয়া ৪০ বস্তা সার তুলা হয়েছে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন, এগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। দামিহা ৬নং ওয়ার্ডের সাব ডিলার শারজাহান ডিলারের দোকানে গেলে দোকানদার বাহার উদ্দিন বলেন, আমি আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ৪০ বস্তা ইউরিয়া সার ক্রয় করেছি। আপনি ও আপনার ডিলারের স্বাক্ষরে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ইউরিয়া ১৯০ বস্তা সার তুলা হয়েছে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন, আমি ছাড়া আমার ডিলারের সার অন্য কেউ উত্তোলন করে না। সালাম ডিলারের ম্যানেজার লিটন বর্মন আমাদের স্বাক্ষর জাল করে খাতাপত্রে সার লিখে রেখেছে। অন্যান্য সাব ডিলারগণ বলেন, আবদুস সালামের মাধ্যমে খুচরা বিক্রেতা হিসাবে প্রতি মাসের বরাদ্দকৃত সার আমরা পাইনা। যার ফলে আমরা কৃষকদের চাহিদা মোতাবেক সার দিতে ব্যর্থ হই। কৃষক তাদের চাহিদা মোতাবেক সার না পাওয়াতে কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে এবং কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। উক্ত ডিলারের নিকট আমরা সার চাইলে না দেওয়ার জন্য উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান রিপনের মাধ্যমে বিভিন্ন অজুহাত দেখায় ও চাহিদা মোতাবেক সার চাইলে দেয় না। এমতাবস্থায় অন্য স্থান থেকে বেশী মূল্যে সার এনে এলাকার কৃষকদের চাহিদা মেটাতে হয়। উপজেলার দামিহা ইউনিয়নের দামিহা নয়াপাড়া গ্রামের কৃষক তমির উদ্দিন, শাহাব উদ্দিনের ছেলে মামুন মিয়া, জালাল মিয়ার ছেলে মামুন মিয়া, মৃত চাঁন মিয়ার ছেলে বাছির উদ্দিন, মুসলিম মিয়া, মৃত রুসমত আলীর ছেলে আওয়াল মিয়া দামিহা বাজারের বিসিআইসি সার ডিলার আবদুস সালামের সারের দোকানের দায়িত্বরত ম্যানেজার লিটন বর্মণের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, সে আমাদের মতো কৃষকদের নাম ব্যবহার করে ও স্বাক্ষর-টিপসই জালিয়াতি করে খাতা তৈরি করে রাখে। তারা আরও বলেন, সিন্ডিকেট করে ইউরিয়া ৩২, টিএসপি ৩০, এমওপি ২৪ ও ডিএপি ২৫ টাকা বা এর চেয়েও বেশি দামে বিক্রি করেন। সার বিক্রির পর ক্যাশ মেমো দেন না।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিলার আবদুস সালাম খাতায় বিভিন্ন কৃষকের নাম লিখে রাখলেও ২/৪ জন কৃষক ছাড়া অন্য কৃষকদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এমনকি এলাকার লোকজনও তাদের চিনতে পারে না। তাছাড়া কৃষি উপসহকারীগণ মাঠ পর্যায়ে তদারকি না করায় বৈধ কোনো কাগজপত্র ছাড়াই ডিলার আবদুস সালাম এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলা, এক ইউনিয়ন থেকে অন্য ইউনিয়নে সার বিক্রি করছেন। কোনো কোনো সাব ডিলারের ব্যবসা পরিচালনা করছেন অন্যরা।
উপজেলার দামিহা ইউনিয়নের মেসার্স সালাম ট্রেডার্সের মালিক বিসিআইসি সার ডিলার আবদুস সালামের কাছে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দামিহা ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনকে ২০১০ সাল থেকে আমার সারের গুদাম ও দোকান বানিয়ে ব্যবহার করে আসছি। সরকারি ভবন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপনার কাছে লিখিত কোনো কাগজ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখনকার সময়ের ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে মৌখিক আলোচনা করে নিয়েছিলাম। অদ্যবধি পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদকে ১০ হাজার টাকা করে মাসিক ভাড়া দিতেছি। সাব ডিলার ও কৃষকদের নাম ব্যবহার করে তাদের স্বাক্ষর ও টিপসই জালিয়াতি করে আপনি সার অন্যত্র বিক্রি করছেন জিজ্ঞেস করিলে তিনি বলেন, আপনাদেরকে খরচাপাতি দেই তারপরও এসব পত্রিকায় প্রকাশ কইরেন না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এবং উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব সুমন কুমার সাহা বলেন, বিসিআইসি সার ডিলার আবদুস সালামকে জিজ্ঞেস করেছি, আপনি সাবেক দামিহা ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনকে দীর্ঘদিন যাবত নিজের গুদাম ও দোকান হিসেবে কিভাবে ব্যবহার করছেন? এই প্রশ্নের তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নাই। তার কাছে কি কাগজপত্রাদি আছে তা নিয়ে আসার জন্য বলেছি। অন্যান্য অভিযোগ গুলো খতিয়ে দেখা হবে।
তাড়াইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও উপজেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি তৌফিকুর রহমান বলেন, দামিহা ইউনিয়নের বিসিআইসি সার ডিলার আবদুস সালাম কর্তৃক বরাদ্দকৃত সার নিয়ে যে কেলেংকারী ও সরকারি ভবনকে নিজের গুদাম ও দোকান হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টি ইতিপূর্বে আমি অবগত ছিলাম না। বিষয়গুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিয়ম না মানলে তার ডিলারশিপ বাতিল করা হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক- খায়রুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক - সোহেল রানা
সম্পাদকীয় কার্যালয়- ৫২২ আইনুল্লাহ স্কুল রোড, স্বল্পমারিয়া, বএিশ, কিশোরগঞ্জ।
০১৯১২৫৫০৭২৭,০১৭২৪৫৭৪২১৭
Copyright © 2024 কালের নতুন সংবাদ. All rights reserved.