মোহাম্মদ মাসুদ
চট্টগ্রাম: শোকাহত চট্টগ্রাম! সারাদেশে কোটা আন্দোলনে পুলিশ ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী ছাত্রদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত হয়েছে ৬জন। চট্টগ্রামে নিহত তিন জন। গুলিবিদ্ধ হয়েছে অর্ধশতর কাছাকাছি। আহত হয়েছে শতাধিক। চট্টগ্রামে নিহত-৫,স্বজনদের কান্না-আর্তনাদ আহাজারি। চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ও চট্টগ্রাম কলেজের অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র ওয়াশিম আকরাম সহ মোট ৫ জন মারা গেছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যালে তিন লাশ ও আহত ৪০, স্বজনদের কান্না-আর্তনাদ স্বজনদের আহাজারি আকাশ বাতাস ভারি করে তোলে । কোটা আন্দোলনে নিহত আকরাম ‘ছাত্রদল নেতা’
নিহতরা হলেন মো. ওমর ফারুক (৩২), ওয়াসিম আকরাম (২৩) ও ফিরোজ আহমেদ (২৪)।
জানা গেছে, আজ বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে নগরীর মুরাদপুর এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিকেল ৪টার দিকে আহত কয়েকজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে ৩ জনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। নিহতদের মধ্যে দুজনের বুকে-পিঠে গুলির চিহ্ন রয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
নিহত ফারুক স্থানীয় একটি ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী এবং কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মো. দুলালের ছেলে। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মেহেরনামা গ্রামের শফিউল আলমের ছেলে। ফয়সাল চট্টগ্রামের ওমরগণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র। এ ছাড়া আহত অবস্থায় ৪০ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে চট্টগ্রাম শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার বিকেলে নগরের ষোলশহর মুরাদপুর এলাকায় এই সংঘর্ষ হয়। এই ঘটনায় তিন জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজন ছাত্রদল নেতা বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বলেন, ‘আন্দোলনে আহত বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে আনা হয়। এর মধ্যে তিন জনকে মৃত ঘোষণা করেছেন চিকিৎসক। আহত ৪০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমরা সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিচ্ছি তাদের।’ ‘এখন পর্যন্ত তিনজন মারা গেছেন। আরও কিছু আহত হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।’
নগর বিএনপির সাবেক সহ দপ্তর সম্পাদক ইদ্রিস আলী বলেন, ‘ছাত্রলীগের গুলিতে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরাম নিহত হয়েছেন। মরদেহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তার লাশ চট্টগ্রাম মেডিক্যালে আছে। তার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায়। সে নগরীর বদ্দারহাটে থাকতো।’
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চট্টগ্রামে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষে তিন জন নিহত ও গুলিবিদ্ধ ১৫ জনসহ আহত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে তিন জনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন আহত ও নিহতদের স্বজনরা। কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা।
স্বামীর মৃত্যুর কথা শুনে হাসপাতালে কান্নায় ভেঙে পড়েন ফারুকের স্ত্রী সীমা বেগম। তার আহাজারিতে চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। এ সময় ওয়াসিমের স্বজনদেরও আহাজারি করতে দেখা যায়।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক নুজহাত ইনু বলেন, ‘আহতদের হাসপাতালে আনা হলে তিন জনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ওয়াসিমের শরীরে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন আছে। ফারুককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আনা হয়েছিল। তার বুকে গুলি লেগেছে। ফয়সালের পিঠে গুলির চিহ্ন আছে।’
সন্ধ্যায় সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, নিহত এবং আহতদের স্বজনদের ভিড়। কান্নাকাটি করছেন অনেকে। জরুরি বিভাগের সামনে সবচেয়ে বেশি ভিড়। শতাধিক স্বজন ভিড় করেছেন। তাদের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। ভিড়ের কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে বলে হাসপাতালের স্বেচ্ছাসেবীরা বারবার স্বজনদের সরে যেতে মাইকে অনুরোধ করে যাচ্ছেন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, নগরীর মুরাদপুর এলাকায় এই সংঘর্ষ শুরু হলেও তা ছড়িয়ে পড়ে বহদ্দারহাট থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত। কয়েক কিলোমিটার এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কয়েকজন অস্ত্রধারীকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। আহত হয়ে আন্দোলনকারীরা সেখান থেকে সরে গেলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হামলা ও গুলি ছুড়েছেন যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে অন্তত শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ পর্যন্ত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে।
আহতদের রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সহপাঠী এবং পথচারীরা অ্যাম্বুলেন্স, ভ্যান এবং রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যান। অনেকে আহত হয়ে আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এসআই নুরুল আলম আশিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সংঘর্ষে আহত বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এর মধ্যে তিন জনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। আহত অন্তত ৪০ জনকে বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চট্টগ্রাম সিটি ইউনিটের প্রধান আবু নাঈম তামজিদ বলেন, ‘আমরা আহত ১৯ জনকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে এনেছি। আহতদের বেশিরভাগকে আনা হয়েছে মুরাদপুর এলাকা থেকে। আরও অনেকে আহত হয়েছেন। তাদের ঘটনাস্থলেই চিকিৎসা দিয়েছি আমরা।’
চট্টগ্রাম মহসিন কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মায়মুন উদ্দিন মামুন বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের চিহ্নিত ক্যাডাররা। তাদের হামলায় ছাত্রলীগের অন্তত ৫০ জনের বেশি নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি আমরা।’