অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম
“দুর্নীতি কি নীতিতে পরিনত হচ্ছে” রহমান মৃধা এই হেডিং নির্ধারন করে দৈনিক সংবাদ এ উপসম্পাদকীয়তে ১১ ডিসেম্বরে ২০২৩ এ একটি কলাম লিখেছেন।আমি তাকে এই সৎসাহসের জন্য সাধুবাদ জানাই। তলে তলের কাজ চলছে দুর্নীতির ক্ষেত্রেও। অসহায় জনগণ মেনে নিয়েছে তা।কি করবে? বিবেকবানরাও চেয়ে চেয়ে দেখছে। করছে না কোন প্রতিবাদ। কারণ প্রতিবাদ করলে দেহে থাকবে না চাল,চামড়া, মাথা বা হাত পা। সততা দুঃখের দহনে করুণ রোদনে তিলে তিলে হচ্ছে ক্ষত বিক্ষত । নীতি নৈতিকতা ও মানবতাকে জানাচ্ছে ধিক্কার। চোখকে বলছে ঘুমাও, সত্যের মরণ দেখে পালন করো নীরবতা। সত্যবাবু দিয়েছে কানে তুলা। কয় না সাদাকে সাদা,বরং ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপে। ঘোমরা মুখে বসে থাকে চায়ের টেবিলে মাথায় রেখে হাত। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথাছিলো না। আমরা কি এ কারণেই একাত্তরে স্বাধীনতা এনেছিলাম।
দুনীর্তি, দাম্ভিকতা, লুটপাট,পেশী শক্তি, মানবতাহী
নের আস্ফালন দেখে, চলে যাচ্ছে বিদেশে আমার দেশের আমলা,কামলাসহ বৃহৎ জনগোষ্টি।কেউ কেউ গড়ে তুলছে ওসমস্ত জায়গায় সেকেন্ড হোম।দৈত নাগরিত্বের সুবিধা ভোগ করছে। সব সময় পাসপোর্টে ভিসা লাগিয়ে রাখে ।দেশে সমস্য দেখা দিলেই বিমানে ওঠে পাড়ি জমাবে নিরাপদ আশ্রয়ে। অবৈধ অর্থের মালিক,লুটপাটকারী, চুর চুট্টারা তো পকেটে ভিসা পাসপোর্ট নিয়েই চলাফেরা করে ও ঘুমায়। তাদের মেধা, অর্থ সেখানে ব্যয় করে, সে দেশের উন্নয়নকে করে সমৃদ্ধ। নিয়ে যায় পৈতৃক ভিটে মাটি বিক্রি করে এ দেশের স্থাবর, অস্থার সম্পদ। কে এবং কিভাবে ফেরাবে তাদের।
আমার মেধাবী ক্লাশমেট, যার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু স্বজনপ্রতি ও দুর্নিতির কারণে তার ভাগ্যে তা জুটেনি। তার হাতের সম্বল ছিলো ভালো ফলাফল।কোন মামা চাচা ছিলো না, কে করবে তার জন্য তদবীর বা সুপারিশ।মনের দুঃখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে।ওখানেই করছে স্থায়ী ভাবে বসবাস। মেধা , টাকা, সম্পদ এভাবেই পাচার হয়ে যাচ্ছে , বিদেশকে করছে ধন্য। চৌদ্দপুরুষের ভিটা মাটির জন্য মন কাঁদলেও আর আসে না ফিরে।
আরো একজন মেধাবী, প্রগতিশীল, ও গভর দেশপ্রেমিক,সৎ,আদশর্বান প্রকৌশলীকে দেখেছি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে। একটা প্রাইভেট কম্পানীতে কাজ করতো। দুনীর্তি করতো না বলে পিস্তলের মুখোমুখি হয়ে চাকুরী ছেড়ে দেয়। দেশ ছাড়ার সময় সে বলে ছিলো – হাতে কিছু টাকা হলেই দেশে ফিরে আসবো, ভালো ধারার রাজনীতিকে বিকশিত করবো।ফিরে এসেছিলো, চেষ্টা করেছিলো টিকে যেতে। রাজনীতির প্যাচ ও ছিনতাইকারীর কবলে পরে সব হারিয়ে প্রাণটা হাতে নিয়ে ফিরে যায় বিদেশের মাটিতে। তাছাড়া বাংলাদেশের আবহাওয়া,রাস্তার যানজট, দৈনন্দিন জীবন প্রণালী তার সন্তানরা একদম পছন্দ করতো না।কারণ এ দেশ ও দেশেরসংস্কৃতি,মাটি,মানুষ,কালচারের সাথে মানায় না তাদের চিন্তা চেতনা।সেই যে গেলো আর আসেনি ফিরে। একদিন ঐ দেশের মাটিতেই সে মিশে যাবে।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের জনগণ বহু ভাগে বিভক্ত। উচ্চভিত্ত – নিম্নভিত্ত, মুক্তযুদ্ধের পক্ষশক্তি – মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি, ধর্মান্ধ- প্রগতিশীল, বিবেকবান- বিবেকহীন, লুটপাটকারী- নীরবদর্শক, ইত্যদি আরো বহু ভাগে বিভক্ত। উচ্চ বিত্তরা এসি ঘরে ঘুমায়,খায় ফাস্ট ফুড, এ দেশ ছেড়ে ওদেশে গায়ে সুগন্ধি মেখে ঘুরে বেড়ায়।কিন্তু কার টাকায়? তৃণমূল জনগনের ঘাম ঝরানো টাকায়।আর ভিত্তহীনরা খেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকলেও আদর্শ হারায় না। দেশ প্রেমে তারা সর্বদা থাকে কমিটেট।একাত্তরে
মাথায় গামছা, ছ্যাড়া লুঙ্গি পড়া লোকরাই অস্ত্রের মুখোমুখো দাঁড়িয়ে দেশ স্বাধীন করছি। তারা কোন সুবিধা পায়নি বা নেয়নি।
এখন এক দল বলে একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠুক আরেক বার। এরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দেশ প্রেমি লোক।আর একদল বলে পচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠুক আরেক বার।এরা একাত্তরে পরাজিত শক্তি ও পচাত্তারে বঙ্গবন্ধুর ঘাতক সম্প্রদায়। মা নামক দেশ চলছে বিপরীত মুখী দুই আর্দশকে বুকে নিয়ে। এরা প্রায় সবাই দুঃসহনীয় জিলাপির প্যাচে হাঁটে। তা দেখে কেঁদে মরে দুবর্ল প্রজাতির বিবেকবানরা। তাদের টাকা বা পেশীশক্তি কোনটার জোর নেই।গলা উচু করে সত্য কথা বলবে, সে সাহসও নেই বুকে। বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আত্মমর্যাদাকে লুকিয়ে রাখে বিবেকের ঘরে। ব্যথিত হয় দেশ ও দশের কষ্টে।তারা বাড়তি সম্মান চায় না। চায় না পদ, পদবী, মন্ত্রীত্ব, কোটি কোটি টাকার দামী গড়ি,ফ্লাট বাড়ি বা আরো বিলাসবহু সুবিধা। বরং যত্রতত্র যন্ত্রাস,লুটপাট,বিদেশে টাকা পাচার, দেশকে ধ্বংশের দিকে ঠেলে দেয়া দেখে হা হুতাশ করে। তারা বলে — একাত্তরে জীবন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম কি — এই অপআদর্শের দেশ চিত্র দেখতে।
এই তো সেদিন একটি সরকারী অফিসে গিয়েছিলাম, কিছু সরকারী পাওনা পরিশোধ করতে। আমার মতো অনেকেই একই কাজে এসেছিলো।সবাই সিরিয়ালি বসে ওয়ান বাই ওয়ান কাজ করছিল। যিনি সরকারের পক্ষে কাজ করছিলেন, তার নম্রতা,ভদ্রতা,কাজের কৌশল দেখে অভিভুত হয়েছিলাম।ভাবছিলাম প্রত্যেকটা লোক যদি এ ভাবে কাজ করতো, তা হলে দেশ তো বহু আগেই উন্নত দেশে পরিণত হয়ে যেতো। তাঁর সহকারী ছিলো ছিলো দুই জান, তারা কি যেনো কান কথা বলছিলো সেবা গ্রহনকারীদের সাথে। তাদের চোখে মুখের ভাষা উদ্ধার করার জন্য অনুসন্ধানী দৃষ্টি প্রসারিত করি।
প্রায় এক ঘন্টা বসে থেকে বৃদ্ধ এক জন মহিলা সরাসরি অফিসারের সাথে গোপন কথা বলতে চাইলো ও বললো। তখন আমার চোখ ওঠে গেলো কপালে। প্রকাশ্যে এ কি হচ্ছে। দুর্নীতির গন্ধ তো লাফালাফি করছে তাদের নাকে মুখে। কান ও চোখটা বাড়িয়ে দিয়ে যা উপলদ্ধি করলাম তা আমাকে মর্মাহত করলো।
সরকারকে ঠকিয়ে সেবা গ্রহনকারীকে সুবিধা দিচ্ছে,মাঝ পথে বসে ফাইলের ভাজে সরকারী কর্মকর্তা সেও সুবিধা নিচ্ছে।তবে নিজের হাতে নয়,সেই সহকারীরা করছে দরকষাকষি ও ফয়সালা।মোবাইল নাম্বার ধরিয়ে দিয়ে দিন তারিখ নির্ধারন করছে। সব দেখে ও বুঝে নিজেকে কোন শান্তনাই দিতে পারছিলাম না। জোহরের আষান পরার পর তারা গলাগলি করে নামাজ পরতে গেলো।লক্ষ্য করলাম তাদের কপালে নামাজ আদায়ের একটা কালো চিহ্নও জ্বলজ্বল করছে। পাঠক আপনারাই বলুন দুর্নীতির ধরন কত প্রকার ও কি কি এবং কারা অসৎ ও দুর্নীতিবাজ।
আমরা জানি এই দিন দিন নয়,আরো দিন আছে।
সব কাজের জবাবদিহি করতে হবে পরপারে।সেই দিনের কথা কি দুর্নিতিবাজ,ঘোষখুররা ভাবে? যত দিন ক্ষমতা থাকে হাতে, ততদিন ভাবে না। যেদিন অবসরের ফিতা কেটে দিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয়, টুপি,জায়নামজ। হাতে তুলে দেয় তজবি, তখন কান খাড়া হয়। চোখের সামনে ভাসতে থাকে দোযকের আগুন।
হাত পায়ের শক্তি কমে আসলে লাফিয়ে পড়ে জায়নামজে।এবাদত করতে করতে ও হে আল্লাহ মাফ মাফ করে দাও বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে।দান, খয়রাত, হজ্জ, যাকাত আদায় করতে করতে জীবনটা পারলে কয়লা করে দেয়। তখন তাদের মনে হয়,এই দুনিয়ার কিচ্ছু কারো না। পৃথিবীতে আসছে একা, যাবেও একা।সঙ্গের সাথী হবে খালি হাত পা। টাকার প্রাসাদ, নাম, পদবী,সুখ্যাতি,সোনা খচিত সিংহাসন পাশে রেখে ঘন ঘন হাই তুলে নিঃশ্বাস ফেলে ও মুখ গোমড়া করে বসে থাকে । তারপরও কেন মানুষ অকাম, কুকাম করে, অর্থের গৌরবে পা ফেলে না মাটিতে। কেনর দুর্নিতি সীমাহীন সিমানা অতিক্রম করে যাচ্ছে।এর উত্তর কোথায় পাবো? কোন অভিধানে লিখা আছে।
লেখকঃ উপদেষ্ঠামন্ডলির সদস্য,বাংলাদেশ কৃষকলীগ।
০১৭১৭৭৬২৭৪৫