অধ্যক্ষ গোলসান আরা বেগম পিএইচডি:
একটি বর্ণ ম এর সঙ্গে আ প্রত্যয় যুক্ত করে পৃথিবী বিখ্যাত মা শব্দের জন্ম হয়েছে।
মা মানে মানব শিশুর জন্ম দাতা। মা' ই সর্ব প্রথম স্তনের দুধ সদ্য জঠর নিসৃত শিশুর মুখে তুলে দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে। মায়ের কোলেই পায় প্রথম আশ্রয়, তৈরী হয় মায়ের চোখে চোখ রেখে সখ্যতা।তাই গানের সুরে বলতে হয় -- "মায়ের চেয়ে আপন কেহ নাই।" মা জননী তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা।
আদিম কালে মায়েরা কৃষি কাজ করতো, ঘরে থেকে সন্তান উৎপাদন ও লালন পালন করাই ছিলো প্রধান কাজ।মাতৃতান্ত্রীক সমজ ব্যবস্থার প্রচলন ছিলো। নারীরা ছিলো সমস্ত অর্থ সম্পদের মালিক।এমন কি সন্তানেরও মালিকানা মায়ের ছিলো। নারীর সিদ্ধান্তে চলতো সমাজের চালিকা শক্তি। পারিবারিক বন্ধন ছিলো না বিধায় যে কোন নারী পুরুষে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো। সনাক্ত করা যেতো না সন্তানটি কোন পুরুষের।
অতঃপর নারী পুরুষে বিবাহ বন্ধনের প্রথা চালু হওয়ার পর, সুচতুর পুরুষরা তাদের আদিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রবর্তন করে পুরুষতান্ত্রীক সমাজ ব্যবস্থা।সেই থেকে মায়েরা হারায় সমাজের কতৃত্ত্ব ও হয় গৃহবন্দি।গৃহপালিত পশুর জীবন যাপন মেনে নেয়। তখন থেকে শুরু হয় নারী ভাগ্যের বিড়ম্বনা।
পৃথিবীতে নারীর জন্য তৈরী হয় নরক যন্ত্রণা। আরব দেশে মেয়ে শিশুকে জীবিত কবর দিতো। স্বর্গের প্রলোভন দেখিয়ে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারতো স্ত্রীকে।মাটিতে পুতে স্বামীর সাথে বাধ্য করেতা
স্ত্রীকে সহমরণে। এই নির্দয় প্রথা চলতে থাকে হাজারের পর হাজর বছর। বহু দেন দরবার, কাঠ খড় পুড়ানোর পর রাজা রাম মোহন রায়ের নেতৃত্বে ও বৃটিশ বড় লাড বেন্টিকের নির্দেশে নির্দয়, নির্মম আচার আচরণসহ সতিদাহ প্রথার বিলুপ্তি ঘটে।
তারপর সমাজপতিরা নারীর হাতে পায়ে পড়িয়ে দেয় নানা বিধি নিষেধের শেকল। এই করতে পারবে না, সেই করতে পারবে না ইত্যাদি অবদমনের নীতি নৈতিকতা। স্মৃতি শাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা মনু নারীকে মিথ্যার মতো অপবিত্র বলেছেন এবং
বেদপাঠের অধিকার হরণ করেছেন।খ্রিষ্ঠধর্ম মতে নারী পৃথিবীতে পাপ আনায়নকারী ও পুরুষের পতন সৃস্টিকারী। মহা ভারতে ভীষ্ম বলে গেলেন--নারীর চেয়ে অসূচি আর কিছু
নেই।পূর্ব জন্মের পাপের ফলে নারী জন্ম হয়। এতো সব অপবাদ সহ্য করেও নারী সংসারের জোয়াল টানছে।
হাজার বছরের ক্লান্তি ঝেরে ফেলে দিয়ে,নারীর অবদমনের চাকা ঘুরে শুভ সূর্যের উদয় হয়। নারী জাগরণের ও মুক্তির হাওয়া বইতে শুরু করে।নারীও হাতের বিরুদ্ধে হাত তুলে যুদ্ধ করতে শিখে। পায়ের নীচে জড়ো করে শক্ত মাটির গাঁথন। সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে সমাজপতিরা করুণার চোখ তুলে তাকাতে বাধ্য হয়।মুল্যায়িত করতে থাকে নারীকে। সেই দুঃসময়ে নারী জাগরণের আগ্নি শিখা নারীর হাতে তুলে দেয় নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। প্রীতিলতার মত সাহসী নারীরা জীবন উৎসর্গ করে, নারী সমাজকে পরিনত করে দুঃসাহসিক লৌহ মানবিকে।
নারীরা আধুনিক বিশ্বে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নেমে আসে আন্দোলনে, লড়াই,বিপ্লবে, রাস্তায় প্রতিবাদ প্রতিরোধের মিছিলে। একের পর একাধিক করে আন্তর্জাতিক সন্মেলেন। উচ্চারণ করতে থাকে তাদের মুক্তির বাণী। আকাশে বাতাসে তুলে নারী জাগরণের ঝড়। সামজিক দুষ্টি ভঙ্গিকে করে নমনীয়।ফলে নারীর মর্যাদা ঘরে বাইরে বাড়তে থাকে। এখন আমরা এক হাতে বলি --জনম দুখী মা, অন্য হাতে বলি -- মায়ের চেয়ে আপন কেহ নাই।
নারী জানে সন্তান জন্ম দেয়া কতো ব্যথা, বেদনা ও কষ্টদায়ক। জঠরের ছোট ঘরে মানব সন্তানের রক্ত কণা ভ্রুণের জন্ম নিলে, নারীর দেহে নানা উপসর্গ দেখা দিতে থাকে। কেউ কেউ খেতে পারে না, কেউবা বমি করতে করতে কাহিল হয়ে যায়।তারপরও সন্তানের মুখ দেখার স্বপ্নে নারী নামে মরণ পণ লড়াইয়ে। গর্ভবতী নারীর দেহে অবগাঠামোগত পরিবর্তন আসে। এক অদ্ভুত প্রাণীর মতো দেখা যায়। স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারে না।পেটটা উচু হয়ে বুকের উপরে ওঠে যায়।রাতে ঘুমাতে কস্ট হয়। বহু কস্ট সহ্য করে নারী মা হতে চায় বা হয়।
পেটের বাচ্চাটি জঠরের ঘরে গড়াগড়ি করতে থাকে, লাত্থি দেয় যখন তখন এলোপাতারি।শিশুটির দেহে পরিপক্কতা আসলে,অন্ধকার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে হামগুড়ি দিতে থাকে। সব পরিস্থিতি ঠিকঠাক থাকলে একটা বিকট চিৎকার দিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসে। মা পায় মরণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। নয় মাসের কষ্টের অবসান ঘটে।
নারীর প্রতি দয়া দেখিয়ে বা মর্যাদা দিয়ে বলছে --মায়ের পায়ের নীচে সেই সন্তানের বেহেশত। মাকে দেবীর আসনে বসিয়ে করছে পূঁজা। তার মানে হলো বেহেশত পেতে হলে মায়ের সেবা যত্ন করতে হবে। মা 'কে খুশী করা মানে বেহেশত পাওয়া। বাস্তব চিত্রটা কি স্রোতের পক্ষে প্রবাহিত।
সংখ্যা গত হারে কম হলেও,বহু সন্তান মাকে নির্যাতন করে, মা'কে রেখে আসে বৃদ্ধাশ্রমে, গলা ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দেয়।এমন কি সম্পত্তির প্রলোভনে খুন করে ফেলে। এতো ক্রাইসিসের পরও মা দিবস, নারী দিবস উদযাপন মায়ের প্রাণে ভালোবাসার সঞ্চার ঘটায়।
এ দিবসকে ঘিরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বসে আলোচনার আসর। ক্ষনিকের জন্য হলেও মাকে, মায়ের সফলতাকে তুলে আনে প্রশংসার টেবিলে। হাতে তুলে দেয় গর্ববতী মাকে অহংকারের সন্মাননা পুরস্কার। সরকার গর্ভবতী মাকে অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্রদান করে। সন্তান লালন পালনের জন্য দেয় কর্মজীবি মাকে বেতনসহ ছয় মাসের মাতৃত্ব ছুটি।
বর্তমান বিশ্বে নারী প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে তৈরী করছে নিজস্ব অবস্থান। মায়ের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে। বহু কর্ম যঞ্জের ধারাবাহিকতার পর ১৯১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মে মাসের ২য় রোব বারেকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিবসে তারা মাকে গোলাপী ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়।বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৪০ টিরও বেশী দেশ মা দিবস উদযাপন করে। পৃথিবীর সকল মা'ই যেন সুখে, নিরাপদে মঙ্গলময় থাকেন - এটাই হলো এই দিবসের কাম্য। পরিশেষে বলবো
মা দিবসের অঙ্গিকার হউক নারী পুরুষে সমতা প্রতিষ্ঠার।
ঢাকাস্থ বীরবাংলা ফাউন্ডেশান আমাকে যোগ্য দুই সন্তানের জননী হিসেবে রত্নগর্ভা মা পদক ২০২৩ প্রদান করার জন্য মনোনীত করে। প্রথম সন্তান জায়েদ বিন জসিম, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট,এইচএসবিসি ব্যাংক,বাংলাদেশ। দ্বিতীয় সন্তান জুবায়েদ বিন জসিম, বিসিএস ক্যাডার, সাবডিভিশানেল ইঞ্জিনিয়ার,গণপুর্ত বিভাগ,হেড অফিস। বীর বাংলা ফাউন্ডেশানকে কৃতঞ্জতা জানাই আমাকে সন্মানীত করার জন্য।
লেখকঃ উপদেষ্ঠা সদস্য, বাংলাদেশ কৃষকলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি।০১৭১৭৭৬২৭৪৫.
সম্পাদক ও প্রকাশক- খায়রুল ইসলাম, বার্তা সম্পাদক - সোহেল রানা
সম্পাদকীয় কার্যালয়- ৫২২ আইনুল্লাহ স্কুল রোড, স্বল্পমারিয়া, বএিশ, কিশোরগঞ্জ।
০১৯১২৫৫০৭২৭,০১৭২৪৫৭৪২১৭
Copyright © 2024 কালের নতুন সংবাদ. All rights reserved.