শাহানারা আক্তার,
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার,
হোসেনপুর, কিশোরগঞ্জ ঃ করোনা মাহামারীতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশের শিক্ষাখাতেও বিরুপ প্রভাব পড়েছে। করোনা সংক্রমণের কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছিল সরকার। দীর্ঘ ১৮মাস পর গতবছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নতুন করে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত জানুয়ারিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।
করোনার এই ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বেড়ে গেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২০ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শুমারি (এপিএসসি) অনুযায়ী ২০২০ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭দশমিক ২০শতাংশ। যা ২০২১ সালে এসে হয়েছে ১৪দশমিক ১৫শতাংশ। এক বছরে ঝরে পড়ার হার ৩ শতাংশ কমেছে। দীর্ঘদিন বিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকায় ঝরে পড়ার হার অনেক বেড়ে গেছে। ২০২২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির পর থেকে যেহেতু বিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হয়েছে তাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং শিক্ষকগণ ঝরে পড়া রোধ এবং শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি নির্মূলের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ঝরে পড়া রোধ নির্মূলের জন্য আমি যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি সেগুলো সবার সাথে শেয়ার করছি—-
★করোনাকালে দীর্ঘদিন আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় দেখেছি প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটাই শ্রী’হীন হয়ে পড়েছে। এজন্য আমার ক্লাস্টারের সকল বিদ্যালয়কে পুনরায় রং করিয়ে বারান্দা এবং শ্রেণিকক্ষগুলোতে বর্ণামালা, সংখ্যা ও বিভিন্ন শিক্ষামূলক ছবি অংকন করিয়ে আকর্ষণীয়ভাবে সুসজ্জিত করেছি।
★দীর্ঘদিন যত্নের অভাবে অনেক বিদ্যালয়ে ফুলের বাগানগুলো নষ্ট হয়ে গেছে এবং আগাছায় রুপান্তরিত হয়েছে। আগাছাগুলো পরিষ্কার করিয়ে নতুনভাবে বাগানগুলো পরিপাটিভাবে সাজানোর পাশাপাশি যেসব বিদ্যালয়ে ফুলের বাগান নেই সেখানেও ফুলের বাগান করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বিদ্যালয়ের এই আকর্ষণীয় পরিবেশ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
★শিশু মানেই আনন্দ চায়, খেলতে পছন্দ করে। দেখা যায়, যখন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ও আন্ত:প্রাথমিক ক্রীড়া হয় তখন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অনেক বেড়ে যায়। তাই আমরা সপ্তাহের ১মদিন শনিবার এবং শেষদিন বৃহস্পতিবার শ্রেণি কার্যক্রমের পূর্বে, টিফিন আওয়ারে বা ছুটির পরে শ্রেণিভিত্তিক দৌড়, চকলেট দৌড়, লুডু, ক্যারাম, ফুটবল, ক্রিকেট, কাবাডি ইত্যাদি খেলার আয়োজন করেছি। যা শিশুদের যেমন নান্দনিক এবং মানসিক বিকাশ ঘটাবে তেমনই তাদেরকে বিদ্যালয়মুখী করবে।
★ বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডও শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। কোন নির্দিষ্ট দিনে শ্রেণিকক্ষে বা শ্রেণি কার্যক্রম শেষে কুইজ, গান, গল্প বলা চিত্রাংকন, ছড়া /কবিতা লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করার উদ্যোগ নিয়েছি। এতে একদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে উঠবে অন্যদিকে প্রেষণা তাদের বিদ্যালয়মুখী করবে।
★দীর্ঘদিন ঘরে থাকার কারণে যেহেতু শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং পড়াশোনার অভ্যাস নষ্ট হয়েছে সেহেতু শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করার ক্ষেত্রে শিক্ষকগণকে সতর্কতা এবং বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে। যেমন: তাদের মনোযোগ ধরে রাখতে তাদের বিনোদন দেওয়া, ছড়া, গান, কবিতা এবং গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে যথাসম্ভব পাঠদান প্রক্রিয়া মজাদার করার চেষ্টা করতে হবে।
★শিক্ষার্থীরা খুব ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। তাই তাদের, ভ্রমণ, সামাজিক ও সৃজনশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতি মাসে একদিন নিজ উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও দর্শণীয় স্থানগুলো পরিদর্শন করানোর উদ্যোগ নিয়েছি। ভ্রমন করে শিক্ষার্থীরা যেমন আনন্দ পাবে তেমনই তাদের পরিবেশ -পরিচিতি এবং প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করবে।
★বিগত দুই বছর যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ও বার্ষিক পরীক্ষা হয়নি এবং শিক্ষার্থীদের ওয়ার্কশীটের উপর মূল্যায়ন করে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হয়েছে ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে পরীক্ষা বিমুখ। তাই ক্লাসের পড়া ক্লাসে শেষ করে ছোট ছোট প্রশ্ন করে, কুইজ, শ্রুতলিপি, রিডিং টেস্ট, বাড়ির কাজ দেওয়া এবং মূল্যায়ন করতে হবে।
★করোনাকালে হোমভিজিট করার সুযোগ ছিলোনা। যদিও শিক্ষকগণ অভিভাবকগণের সাথে নিয়মিত মোবাইলে যোগাযোগ রেখেছেন তবুও শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে শিশুদের পড়াশোনা মানোন্নয়নের যে প্রচেষ্টা ছিল তা অনেকাংশেই ব্যাহত হয়েছে। তাই শিক্ষকগণকে জোড়ালো হোমভিজিট করার নির্দেশনার পাশাপাশি আমি নিজেও মাঝেমাঝে হোম ভিজিটে গিয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের উৎসাহিত করছি। এতে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা অনেক উৎসাহিত হচ্ছে।
★দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় মা ও অভিভাবক সমাবেশ না হওয়ায় অভিভাবকদের সাথে বিদ্যালয়ের মানসিক দূরত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই প্রতিটি বিদ্যালয়ে শ্রেণিভিত্তিক মা ও অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করে অভিভাবকদের সাথে বিদ্যালয়ের নিবিড় সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে। প্রত্যেকটি সমাবেশে আমি নিজে এবং আমার ঊর্ধ্বতন কোন কর্তৃপক্ষকে উপস্থিত রাখার চেষ্টা করছি। এতে অভিভাবক এবং শিক্ষকদের মধ্যে যেমন সুসম্পর্ক সুন্দর থাকবে তেমনই ঊর্ধ্বতনদের সাথেও যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে।
★করোনাকালীন সময়ে মানুষদের মধ্যে যে ভয় বা ভীতি তৈরি হয়েছিল তা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সারাদেশে এখন সর্দি, জ্বর (ফ্লু), ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এসবের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। তাই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শারীরীক সুস্থতা নিশ্চিত করতে দৈনিক সমাবেশে স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতামূলক পরামর্শ, ক্ষুদে ডাক্তারদের দিয়ে নিয়মিত চেকআপ করতে হবে। যেমন: তাপমাত্রা, ওজন, দৃষ্টিশক্তি, নখ ও চুলকাটা, হালকা শরীরচর্চার ব্যবস্থা ইত্যাদি। এতে শিক্ষার্থীরাও সুস্থ্য থাকবে এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্পর্কিত জ্ঞানও অর্জন করবে।